"ঝরে কত তারা আলোকে মনে রাখে বলো কে?"
এই বিশাল আকাশের দিকে তাকালে হাজার হাজার তারা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাতের মেঘমুক্ত আকাশে আমরা তাদের দিকে চেয়ে থাকি অনেকক্ষণ। অথচ আমরা সবার নাম জানি না। মনেও রাখি না। তেমনই "মোহনবাগান" নামক এক বিশাল মহীরুহের ছত্রছায়ায় নিজেদের জায়গা করে গেছেন কত শত "তারা"রা। আমরা কি সবাইকে মনে রেখেছি? কালের গর্ভে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে কত চরিত্র, কত নাম, কত প্রতিভা, কত রেকর্ড। তেমনই এক বিরল প্রতিভা আগমন ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় একানব্বই বছর আগে।সালটা ১৯৩৩। রাণু দেবীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস। শিক্ষা, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বাংলা নিজের ভিত সুদৃঢ় করলেও গোটা দেশ জুড়ে চলেছে এক দমবন্ধ করা রাজনৈতিক পরিবেশ। আইন অমান্য আন্দোলন প্রতিরোধে ব্রিটিশ সরকার পাল্টা আইন প্রণয়ন করে চালাচ্ছে নির্মম দমন পীড়ন। যদিও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এরকম দমবন্ধকর অবস্থার মধ্যেও বাংলার মানুষকে কিছুটা মুক্তির স্বাদ দিয়েছিল সেই ব্রিটিশদের কাছেই শেখা ফুটবল- তাদের খেলায় তাদেরকেই হারিয়ে। সৌজন্যে মোহনবাগান। কিন্ত এরপর কেটে গেছে প্রায় দুই দশক। ঐতিহাসিক শিল্ড আর জেতেনি মোহনবাগান। ১৯১২ তে জোর করে, একাধিক ন্যায্য গোল বাতিল করে মোহনবাগানকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে শিল্ডে আবার অংশ নিলেও শিকে ছেড়েনি। তবে বেশ কয়েকবার মোহনবাগান ঝুলিতে পুড়ে নিয়েছিল সেসময়কার জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট কোচবিহার কাপ। এছাড়া এসেছে ক্যালকাটা সকার লিগ, গ্রিফিথ শিল্ড, লেসলি চ্যালেঞ্জ কাপের মত ছোট ছোট কিছু টুর্নামেন্ট। সবুজ মেরুন জার্সি অলঙ্কৃত করেছেন গোষ্ঠ পাল, করুণা ভট্টাচার্য, উমাপতি কুমারের মত ভারতীয় ফুটবলের মহারথীরা। কিন্ত বড় টুর্নামেন্টে আশানরূপ সাফল্য এসময়ে অধরাই ছিল মোহনবাগানের।
এমন অবস্থায় মোহনবাগানে আগমন সতের বছরের এক তরুণের- সকলে তাকে ডাকেন 'কানি' বলে। অভিলাষ ঘোষ অবসর নিয়েছেন। তাঁর জুতোয় পা গলাতে চায় কানি। মোহনবাগানে যোগ দিয়েই নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাতে শুরু করল সে। গোলের পাশাপাশি নিখুঁত থ্রু বাড়ানো, ড্রিবলিং-এও তার ফুটবল প্রতিভার ঝলক দেখা যায়। মোহনবাগানের অধিনায়ক সেসময় সম্মথ নাথ দত্ত।
৩০ শে আগস্ট। দ্বারভাঙা শিল্ডের বেঙ্গল জোনের ইন্ডিয়া সেকশনের ফাইনাল। মোহনবাগান মুখোমুখি ইস্টবেঙ্গলের। সতের বছরের তরুণ কানি ইস্টবেঙ্গলের জালে বল জড়িয়ে শোরগোল ফেলে দিল বাংলার ফুটবল মহলে। কানি এবং কে বোসের গোলে ইস্টবেঙ্গল কে ২-০ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের জন্য দ্বারভাঙা শিল্ড ঘরে তুলেছিল মোহনবাগান। টুর্নামেন্টের ফাইনালেও দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল কানি, ডালহৌসির বিপক্ষে। তারই বিক্রমে একমাত্র দ্বারভাঙা শিল্ড ঘরে তোলে মোহনবাগান।
এগিয়ে যাওয়া যাক এক বছর- ১৯৩৪। সেই দ্বারভাঙা শিল্ডেরই বেঙ্গল জোনের ইন্ডিয়ান সেকশনের ম্যাচ, তবে এবার সেমিফাইনাল। সামনে সেই ইস্টবেঙ্গল। দিনটা ছিল পাঁচই সেপ্টেম্বর। মোহনবাগান- ইস্টবেঙ্গল এর কমন গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত ম্যাচে আঠারো বছরের তরুণ কানি ঘটিয়ে ফেলল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। একাই চার চারটি গোল করে সবুজ মেরুনের নায়ক সে! হ্যাঁ, এই কানিই অমিয় দেব- কলকাতা ডার্বির ইতিহাসের প্রথম হ্যাটট্রিকের মালিক। যদিও তখনও "ডার্বি" শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হতে বাঙালীর অনেক দেরী!
শুধু হ্যাটট্রিক নয়, চিডি এডের ডার্বিতে করা চার গোলের ৭৫ বছর আগে একাই সেদিনের ৪-১ ফলাফলের ম্যাচের চারটি গোল করেছিলেন অমিয় দেব, সবার প্রিয় কানি। সেদিন দুটো অর্ধেই দুটো করে গোল করেছিলেন তিনি। ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক তথা গোলরক্ষক মণি তালুকদার চার চার বার পরাস্ত হয়েছিলেন তাঁর কাছে। দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম গোলটি অর্থ্যাৎ হ্যাটট্রিকের গোলটি এসেছিল পেনাল্টি থেকে, আর চতুর্থটি হেডে।
ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে যেন জ্বলে উঠতেন তিনি। মোট নয়টি বড়ম্যাচ খেলেছিলেন অমিয় দেব। একটি দুর্ঘটনায় মাত্র একুশেই ফুটবলকে বিদায় জানানোর আগে মোট সাতবার বল জড়িয়ে ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের জালে। ১৯৩৫-এর আটই আগস্ট দ্বারভাঙা শিল্ডের ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলকে তাঁর গোলেই হারিয়েছিল মোহনবাগান। এরপর ১৯৩৬ সালের বারোই আগস্ট লেডি হার্ডিঞ্জ শিল্ডের ফাইনালেও তিনি লাল-হলুদের বিপক্ষে গোল করেছিলেন। খেলার ফল ছিল মোহনবাগানের পক্ষে ২-০। এটিই ছিল ডার্বিতে করা অমিয় দেবের শেষ গোল।
দ্বারভাঙা শিল্ড 1934-এর বেঙ্গল জোনের দলসমূহ এবং সূচী |
খবরের কাগজে অমিয় দেবের হ্যাটট্রিকের রিপোর্ট |
শুধু ফুটবল নয়, ক্রিকেট আর হকিতেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন অমিয় দেব। মোহনবাগানের ক্রিকেট আর হকি দলেরও গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। হকিতে মূলত রাইট আউট পজিশনে খেলতেন, করেছেন মোহনবাগান হকি দলের অধিনায়কত্ব। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সেই হকিতে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়ে মোহনবাগানকে এনে দেন হকি লিগের শিরোপা। বাংলার হকি দলের প্রতিনিধিত্বও করেছেন অমিয়। এমনকি পরেছিলেন ভারতের জাতীয় হকি দলের জার্সিও। ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিকের দলগঠনের জন্য জাতীয় দলের ট্রায়ালে ডাকা হয় অমিয় দেবকে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দেশের অন্যতম সেরা উইং ফরওয়ার্ড হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচিত দলে সুযোগ হয়নি অমিয় দেবের!
ফুটবলকে অকালে বিদায় জানাতে হলেও ক্রিকেট থেকে অবসর নেননি অমিয়- বাংলা দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, হয়েছিলেন মোহনবাগান ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বাংলার হয়ে খেলেছেন রঞ্জি ট্রফি। বাংলার হয়ে তাঁর গড় ত্রিশের ওপর। ১৯৪২-এ রঞ্জি ট্রফির ম্যাচে বেনারসে উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ১২৮ রান- এটিই তাঁর রঞ্জি ট্রফিতে করা একমাত্র সেঞ্চুরি। অমিয় ছিলেন উইকেট রক্ষক- ব্যাটসম্যান (ব্যাটার)। প্রসঙ্গত প্রবীর সেনের পূর্বে বাংলার উইকেট রক্ষকের দায়িত্ব পালন তিনিই করতেন।
ক্রিকেটার অমিয়। উইকেটরক্ষকের ভূমিকায়। Photo courtesy: Mohun Bagan Athletic Club |
প্রতিভাবান এই মাধুষটি শুধুমাত্র ফুটবল, ক্রিকেট এবং হকিতেই থেমে থাকেননি। এবার বলতে চলেছি এমন একটি গল্প, যা অধিকাংশ মানুষের কাছেই অজানা। বলাই চ্যাটার্জির প্রচেষ্টায় মোহনবাগানে বেসবল খেলাও শুরু হয়েছিল সেসময়। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। বেসবল! আর সেটাও তিনের দশকে। মোহনবাগান বনাম ক্যালকাটা ক্লাবের মধ্যে কলকাতায় প্রথম প্রতিযোগিতামূলক বেসবল খেলা হয়। সম্ভবত সেটিই ভারতের বুকে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রতিযোগিতামূলক বেসবল ম্যাচ। কৈলাশনাথ কাটজু ছিলেন তখন বাংলার গভর্নর। তিনি নিজে এই খেলাটি দেখতে উপস্থিত ছিলেন।
কাটজু সাহেবকে নিয়ে দুদলের খেলোয়াড়দের এই গ্রুপ ছবি। অমিয় দেব কাটজু সাহেবের সামনে নিচে বসে আছেন। Photo Courtesy: Mr. Sougata Sen. |
মোহনবাগানের সুদীর্ঘ ইতিহাসে একাধিক খেলোয়াড় রয়েছেন যারা একইসঙ্গে খেলেছেন ফুটবল এবং ক্রিকেট কিংবা হকি। কিন্ত অমিয় দেবের মত একসঙ্গে এতগুলো খেলায় পারদর্শীতার উদাহরণ নেই বললেই চলে। তালিকায় এবার যুক্ত করে নিন টেনিস! সেসময়ে মোহনবাগানের টেনিস কার্নিভালের সুনাম ছিল সর্বজনবিদীত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট, ফুটবল, হকি- তিন দলেরই সদস্য ছিলেন এই প্রতিভাবান মানুষটি। তাঁকে পরবর্তী তে মোহনবাগানের হকি এবং টেনিস সেক্রেটারীর গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রদান করা হয়েছিল। অমিয় দেবের ভাতুষ্পুত্র জয়ন্ত দেব দীর্ঘদিন খেলেছেন মোহনবাগান হকি দলে। আর তাঁর ছেলে ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা প্রয়াত ইন্দ্রজিৎ দেব।
অমিয় দেবের পুত্র অভিনেতা ইন্দ্রজিত দেব |
১৯৮৩ সালের দশই জানুয়ারী, ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন অমিয় দেব, ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন বাংলার ক্রীড়াজগতের এমন এক অভাগা নক্ষত্র, যাকে সময়ের স্রোতে ভুলেই যেতে বসেছিল বাঙালী! অমিয় দেব সেদিন অনন্তলোকের পথে যাত্রা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কীর্তি তাঁর অমরত্বে চিরকালীন এক শিলমোহর ফেলে দিয়েছিল অনেক আগেই। তিনি রেখে গিয়েছেন ভারতের ক্রীড়া ক্ষেত্রে এমন এক বিরল প্রতিভার নিদর্শন, প্রায় এক শতক পরেও যেই প্রতিভার সামনে শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে হয়। ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, টেনিস, বেসবল- এতগুলো খেলায় পারদর্শীতা সত্যিই অকল্পনীয়। অমিয় দেব মোহনবাগানে ফুটবল খেলেছিলেন মাত্র চার বছর। তাঁকে ফুটবলে মোহনবাগানের "লেজেন্ড" বলা যায় কিনা সেই দায়ভার না হয় পাঠকদের ওপরেই থাকল। অমিয় দেব ওরফে কানি যেন শিবদাস, উমাপতি কুমার, গোষ্ঠ পাল থেকে বিমল মুখোপাধ্যায়, শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামীদের মধ্যেকার একটা নিরবিচ্ছিন্ন সেতু, যিনি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন মোহনবাগানের আবহমান "লেগাসি", যিনি রেখে গিয়েছেন কালের গর্ভে চাপা পড়ে যাওয়া এক সত্য, এক রেকর্ড, যা নিয়ে তাঁর মৃত্যুর সাড়ে তিন-চার দশক পরে ঝড় ওঠে, সংশোধিত হয় ইতিহাস।
কলমে - সাগ্নিক চক্রবর্ত্তী।
শ্রী অভীক দত্ত- যার নিরলস গবেষণার ফলস্বরূপ কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া রেকর্ডটির পুনর্জন্ম হয়েছে।