মোহনবাগানের সেকাল থেকে একাল, পুরোটাকেই নথিবদ্ধ করে রাখতে বদ্ধপরিকর MBFT! আজকে, আমাদের “আবহমান মোহনবাগান” সিরিজের প্রথম অধ্যায় : “পথচলার শুরু: কীভাবে শুরু হলো বাংলায় ফুটবল চর্চা, কেনোই বা জন্ম নিলো মোহনবাগান”।
◾ব্রিটিশ শাসন
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের নতুন শাসক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। নিজভূমি ত্যাগ করে ব্রিটিশদের একাংশ এসময়ে জীবিকার প্রয়োজনে ভারতে আসতে শুরু করে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগদান করে। তাদের আগমনে স্থাপত্য, খাদ্য, ধর্ম, সাহিত্য এবং বিনোদন থেকে শুরু করে ব্রিটিশ সংস্কৃতির একাধিক নিদর্শন তাদের সঙ্গে আমাদের দেশে প্রবেশ করে।
এই একই সময়ে ইংল্যান্ডে প্রাতিষ্ঠানিক ফুটবল খেলার প্রসার ঘটে এবং খেলাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এসময়ের "ফুটবল" খেলাকে অনেকটা রাগবি খেলার একটি সংস্করণ রূপে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ১৮০২ সালে বোম্বেতে মিলিটারি এবং আইল্যান্ড নামে দুটি দলের মধ্যে একটি খেলার কথা জানা যায়, যেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক ফুটবলের একটি পূর্বতন সংস্করণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এরকম আরেকটি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ১৮৩৮ এবং ১৮৫৪ তে কলকাতা ময়দানে অনুষ্ঠিত ক্যালকাটা ক্লাব অব সিভিলিয়ন্স এবং জেন্টেলমেন অব ব্যারাকপুরের মধ্যেকার ম্যাচ।
এই খেলাটি কিন্ত যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বাংলা তথা ভারতের ফুটবলের বিকাশে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবদের অদ্ভুত কান্ড কারখানা দেখে তাজ্জব হয়েছিলেন পথচলতি সাধারণ মানুষ। তাঁরা দেখলেন যে ব্রিটিশ সাহেবেরা মেতেছেন একটা আজব খেলায়। একটা চামড়ার গোলাকার বস্তুকে লাথি মারার খেলা! ঔৎসুক 'দর্শকেরা' লক্ষ্য করেন যে তাঁরা খেলছেন দুটি দলে ভাগ হয়ে। এর বেশী আর কিছুই তাদের বোধগম্য না হলেও তাদের চোখে সেটি ছিল যথেষ্ট বিনোদন পূর্ণ। যদিও এরপর সিপাহী বিদ্রোহ এসে কড়া নাড়লে এই বিনোদনের স্বাদ তাঁরা ভুলেই যান এবং এসময়েই শাসনভার কোম্পানির থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে স্থানান্তরিত হয়।
The Old Etonians FC made of the alumni of the Eton College still exists to date. |
◾স্থানীয় কৌতুহল এবং আত্মীকরণ
১৮৬৩ সালে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইংরেজদের মধ্যে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এর পাশাপাশি ভারতীয় উপনিবেশে ম্যাচের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়তে থাকে এবং ক্রমে স্থানীয়দের মধ্যে ফুটবল নিয়ে আগ্রহও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল রবার্ট ভ্যান্সিটার্টও কলকাতার ময়দান এলাকায় এই ধরনের খেলায় সক্রিয় অংশ নিতেন, যেখানে তিনি ইটোনিয়ানদের হয়ে খেলতেন, যা ভারতে চলে আসা ইটোন কলেজের প্রাক্তনীদের দ্বারা শুরু হয়েছিল।
এই ধরনের ঘটনা স্থানীয় বাঙালি যুবকদের কৌতুহলী করে তোলে এবং এই নতুন খেলাটি শহরের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। এই খেলার গল্প ক্রমে ছড়িয়ে পড়তে থাকল কলকাতার অলিতে গলিতে। যদিও ভারতীয়রা এতে অংশ নিতে পারতেন না। তাঁরা দূর থেকেই দেখতেন ইংরেজদের চর্ম গোলকে পদাঘাত করার খেলা। তবে খুব বেশিদিন বাঙালীকে দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়নি এই খেলা। সৌজন্যে আট বছরের এক কিশোর, নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। নগেন্দ্রপ্রসাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্ব এবং ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ তার সহপাঠীদের মধ্যে খেলাটির প্রতি গভীর আগ্রহ গড়ে তোলে। ব্রিটিশ প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক জি. এ স্ট্যাক এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর উৎসাহ, শিক্ষা এবং সহযোগিতায় নগেন্দ্রপ্রসাদ ১৮৮০ সালে ১১ বছর বয়সে বয়েজ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন।
তৎকালীন উচ্চবিত্ত বাঙালি সমাজে শারীরিক খেলাধুলার প্রতি উৎসাহ তো ছিলই না, বরং তাকে গুন্ডামির সমতুল্য মনে করা হত। স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাবে এটি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল, যিনি বারবার সক্রিয় খেলাধুলার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন।
"গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে"
নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী |
◾নগেন্দ্রপ্রসাদের প্রাথমিক ক্রিয়াকলাপ
নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী কলকাতায় এবং পার্শ্ববর্তী হাওড়া জেলায় একাধিক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৮৪ ষালে ওয়েলিংটন ক্লাবটি নগেন্দ্র প্রসাদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বয়েজ, ফ্রেন্ডস এবং প্রেসিডেন্সি ক্লাবের একত্রীকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিন বছর পর তিনি অভিজাত শোভাবাজার পরিবারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ১৮৮৫ সালে যুবরাজ জিতেন্দ্র কৃষ্ণ দেব দ্বারা নগেন্দ্রপ্রসাদের নেতৃত্বে শোভাবাজার ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়।
নগেন্দ্রপ্রসাদ শ্রেণী বৈষম্য মানতেন না। একজন কুম্ভকারের ছেলে মনি দাসের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যখন ওয়েলিংটন ক্লাবের সদস্যদের তীব্র প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হয়, তখন ক্ষুব্ধ নগেন্দ্র ক্লাবটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। জাত-পাত-ধর্ম নির্বিশেষে, সমস্ত রকম শ্রেণীবৈষম্য নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয় শোভাবাজার ক্লাব। সব শ্রেণীর মানুষ হয়ে ওঠেন এই ক্লাবের সদস্য। তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে ভারতে ফুটবল যেন হয়ে উঠতে পারে জনসাধারণের খেলা- এমন একটি খেলা যা সকলকে সমান মনে করে এবং বিভিন্ন বর্ণ, শ্রেণী ও ধর্মের মধ্যে যোগসূত্রের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।
শোভাবাজার ক্লাব প্রতিষ্ঠা বাংলার বুকে শুরু হওয়া ফুটবল প্রবাহকে ত্বরান্বিত করে। এই ক্লাবের দৈনন্দিন ফুটবল চর্চার একটি প্রাণবন্ত চিত্র এঁকেছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক রাখাল ভট্টাচার্য। তিনি লিখেছিলেন, "(শোভাবাজার ক্লাবে) ফুটবল খেলতে তাদের বুটের কথা মনে উদয় হল না। শুধু পায়ে বল শুট করার, পায়ের আঙুল দিয়ে কৌশলে বল টেনে নেওয়ার এবং আলগা পায়ে তরতর করে দৌড়াবার কায়দা রপ্ত করে ফুটবলকে তারা নতুন রূপ দিল।...নিজেদের মধ্যে দলে ভাগ করে খেলে, অন্য পাড়ার ছেলেদের ডেকে এনে ম্যাচে নামায়। তোড়জোড়- হাঙ্গাম- হুজ্জোতের বালাই নেই; গায়ে গেঞ্জি বা শার্ট, পায়ে হাফ প্যান্ট বা হাঁটুতুলে এঁটে পড়া ধুতি ও বল। দুটো বাঁশ পুঁতে দু-মাথায় দড়ি বাধলেই গোল তৈরী হয়।"
স্বাধীনতার সংগ্রামে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধ লড়াইয়ে জয়লাভ করতে ভারতীয়দের মধ্যে আশার আলো জাগিয়ে তোলেন নগেন্দ্র প্রসাদ। তার কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে কালীচরণ মিত্র, বামাচরণ কুন্ডু, মন্মথনাথ গাঙ্গুলি, হরিদাস শীল এবং উমেশ চন্দ্র 'দুখিরাম' মজুমদারের মতো আরও অনেক উৎসাহী যুবক এগিয়ে আসেন এবং নিজেদের ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর এভাবেই বাংলা আর বাঙালীর মজ্জায় ফুটবল খেলাটাকে প্রবেশ করিয়েছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারি এবং তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি। অচিরেই তিনি হয়ে ওঠেন "ভারতীয় ফুটবলের জনক"।
মোহনবাগান ভিলা |
◾মোহনবাগান ভিলা
দুখিরাম মজুমদারের দল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী কীর্তিচন্দ্র মিত্রের একটি ভিলার পাশের মাঠে খেলত। ১ ফারিয়াপুকুর স্ট্রীটের জমিটি ছিল একটি বাগান যার মালিকানা ছিল মূলত শোভাবাজারের রাজা নব কৃষ্ণ দেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা গোপী মোহন দেবের কাছে। আর সেই বাগানেরই নাম ছিল রাধা মোহনের বাগান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে 'রাধা মোহন বাগান "-কে সংক্ষিপ্ত করে' মোহন বাগান" করা হয় এবং গোপীমোহনের বংশধররা পরে সেই জমিটি তৎকালীন বিখ্যাত পাট ব্যবসায়ী কীর্তিচন্দ্র মিত্রের কাছে বিক্রি করে দেন, যিনি তখন বাংলার প্রথম সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও স্থপতি নীলমণি মিত্রকে সাদা মার্বেল দিয়ে সেই জমিতে একটি বিশাল ভিলা নির্মাণের জন্য নিযুক্ত করেন। ভিলাটির নামও এইভাবে মোহনবাগান ভিলা হয়ে ওঠে। মোহন শব্দের অর্থ আকর্ষণীয় বা মোহনীয়।
কীর্তি চন্দ্র ১৩ বিঘা জুড়ে বিস্তৃত প্রাসাদ প্রতিষ্ঠার পরে খুব বেশি দিন জীবিত ছিলেন না এবং প্রাসাদটি তাঁর পুত্র প্রিয়নাথ মিত্রের কাছে চলে যায়; আর এই "মোহন" অর্থ্যাত মনোমুগ্ধকর বাগানেই স্থানীয় স্কুল কলেজের ছেলেরা সন্ধ্যাবেলায় নিয়মিত ফুটবল খেলতে আসা শুরু করে।
মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রথম প্রেসিডেন্ট ভূপেন্দ্রনাথ বোস (বাম) এবং ক্লাবের প্রথম এমব্লেম (ডান) । ধন্যবাদান্তে @mbarchive1889 “X” হইতে) |
◾ তিন স্বনামধন্য পরিবার, একটি অনন্য ক্লাব :
১৮৮৪ সালে ফুটবল খেলার জন্য বুটের ব্যবহারকে কেন্দ্র করে মোহনবাগান ভিলায় দুখিরাম এবং অন্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। দুখিরাম মজুমদার ছিলেন বুট ব্যবহারের পক্ষে। কিন্তু ভিলার বাকি সদস্যরা এই মতকে আমল দেন নি। তিনি একদল ছাত্রকে নিয়ে চলে যান শ্যামপুকুরের মহারাজা দুর্গা চরণ লাহার তেলিপারা মাঠে। সেখানে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত "স্টুডেন্টস ইউনিয়ন"-এর নাম বদলে রাখেন "এরিয়ানস্"। মোহনবাগান ভিলা থেকে আরেকদল ছাত্র চলে গেল বাগবাজারে। সেখানকার প্রসিদ্ধ সেনবাড়ির ছেলেদের নেতৃত্বে শ্যাম স্কোয়ারে তারা গড়ে তুলল "বাগবাজার ক্লাব"। পড়ে রইল কিছু সংখ্যক ছেলে, যারা রয়ে গিয়েছিল মোহনবাগান ভিলাতেই। তাদের কোনো "দল" ছিল না। একদিকে শ্যামপুকুরে এরিয়ান্স, একদিকে শ্যামস্কোয়ারের মাঠে বাগবাজার ক্লাব, আর আরেকদিকে মোহনবাগান ভিলার এই ক্লাবহীন ছেলেরা- এর মধ্যে মোহনবাগান ভিলায় যারা খেলত, তাদের অবস্থাই ছিল সবচেয়ে ছন্নছাড়া- কারণ ওই একটাই- স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তারা কোনো "ক্লাব" গড়ে তোলে নি। তারা কিছুতেই পাল্লা দিতে পারত না অপর দুই দলের সঙ্গে। কলকাতার তিন বনেদী পরিবার- বসু, সেন আর মিত্র বাড়ি প্রত্যক্ষ করলেন মোহনবাগান ভিলার ছেলেদের। তাঁরা উপলব্ধি করলেন যে এই ছেলেদের একটি স্থায়ী ছাতার তলায় এনে একটি দল গড়ে তুলে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা। তাঁরা এগিয়ে এলেন তাদের পৃষ্ঠপোষকতায়।
১৪ বলরাম ঘোষ স্ট্রিট। ১৫ আগস্ট, ১৮৮৯। তিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভূপেন্দ্রনাথ বোসের বাসভবনে একটি সভা বসল। দীর্ঘ আলোচনার পর মোহনবাগান ভিলার ছেলেদের নিয়ে একটি স্থায়ী ক্লাব গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বসু পরিবারের প্রধান ভূপেন্দ্র নাথ বসু এই নবনির্মিত ক্লাবটির নামে প্রথম সভাপতি নিযুক্ত হলেন। আর ক্লাবটির নাম রাখা হল "মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব"।
> দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখানে: মোহনবাগানের প্রথম দু'দশক (১৮৮৯-১৯১০)
> Read EP1 in English Here: The Complete Origin Story of Mohun Bagan
> Read EP2 in English Here : The First Two Decades Of Mohun Bagan (1889-1910)
আমাদের MBFT কে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ট্যুইটার, ইউটিউব, ওয়াটসঅ্যাপ ও গুগল নিউজে ফলো করুন, মোহনবাগান সংক্রান্ত সকল তথ্য সবার আগে পাওয়ার জন্য।