মোহনবাগানের প্রথম দু'দশক | ১৮৮৯-১৯১০ | “আবহমান মোহনবাগান” ২য় পর্ব

মোহনবাগানের সেকাল থেকে একাল, পুরোটাকেই নথিবদ্ধ করে রাখতে বদ্ধপরিকর MBFT! তাই, গতদিনের প্রথম অধ্যায়ের পর, আজকে, আমাদের “আবহমান মোহনবাগান” সিরিজের দ্বিতীয় অধ্যায় : মোহনবাগানের প্রথম দু'দশক (১৮৮৯-১৯১০)।

◾কঠোর নিয়মবিধি :

"শৃঙ্খলাই হল দলের মেরুদণ্ড এবং এটি কঠোরভাবে পালন করা উচিত", মোহনবাগান ক্লাবের সভাপতি শ্রী ভূপেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন এই মন্ত্রে বিশ্বাসী। ক্লাবের মূলমন্ত্র ছিল, "Play the game in the spirit of the game"

সূচনালগ্ন থেকেই মোহনবাগান ক্লাব তাদের সদস্যপদ গ্রহণ করার জন্য কিছু কঠোর মানদণ্ডের প্রবর্তন করে। ক্লাবের সদস্য হতে গেলে শারীরিক শক্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াও বাধ্যতামূলক করা হয়। একটি দ্বিস্তরীয় পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়, যার প্রথম স্তরে ব্যক্তির একাধিক শারীরিক ও মানসিক দিক মূল্যায়ন করা হবে। এর পাশাপাশি নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা, চারিত্রিক অভ্যাস এবং আচরণের দিকেও নজর দেওয়া হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর, একজন সদস্য ক্লাবের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ, এবং চারিত্রিকভাবে দৃঢ়, সেটি কয়েকদিনের জন্য পর্যবেক্ষণ করবেন ক্লাবের কর্মকর্তারা, যার পরেই সেই সদস্যের সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্তি মঞ্জুর করা হবে। ধূমপান, মদ্যপান করা ছিল দন্ডনীয় অপরাধ। 

এভাবে সূক্ষ্ম ছাঁকনিতে ছেঁকে যেমন সদস্যপদ দেওয়া হত, তেমনি সেই সদস্যপদের মর্যাদা বজায় রাখাও ছিল কঠিন। কোনো সদস্য মদ্যপান, ধূমপান বা অন্যান্য আইন ভঙ্গের মতো ক্লাবের নৈতিকতার বিরুদ্ধে কোনও কাজে লিপ্ত হয়ে ধরা পড়লে তার সদস্যপদও অবিলম্বে বাতিল করা হত। মোহনবাগান ভিলার একটি গাছ থেকে কিছু ফল চুরি করার অভিযোগেও এসময়ে একজন সদস্যকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

◾মোহনবাগান "অ্যাথলেটিক" ক্লাব :

Presidency College's Eden Hindu Hostel is regarded to have been the opponents for the first ever match of Mohun Bagan

একাধিক কঠোর নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব তার প্রথম বছর অতিক্রম করে, এবং শীঘ্রই ক্লাবের পুনঃনামকরণের একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতিমান অধ্যাপক ছিলেন এফ. জে. রো সাহেব। ছাত্রদের মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন এবং নিজেও তাঁর ছাত্রদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। ক্লাবের সদস্যদের এবং খেলোয়াড়ের অধিকাংশ সেসময় ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। তাঁরা তাদের প্রিয় অধ্যাপককে মোহনবাগান ক্লাবের বর্ষপূর্তিতে আমন্ত্রণ জানালে তিনি অবিলম্বে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ক্লাবে উপস্থিত হয়ে রো সাহেব ক্লাবের কার্যক্রম এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিদর্শন ও খোঁজখবর নেন। বিস্তারিত জানার পর তিনি ক্লাবের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করেন, ক্লাবটি 'অ্যাঙ্গলিং' বা রাইফেল শ্যুটিংয়ের মত স্পোর্টসে অংশ নিয়েছে কিনা- যেগুলি তখন একটি 'স্পোর্টিং ক্লাব'-এর সাধারণ কার্যকলাপ ছিল। কর্মকর্তারা অস্বীকার করলে, তিনি নামটি "মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবে" পরিবর্তন করার পরামর্শ দেন, যে প্রস্তাবটি সদস্য এবং আধিকারিক উভয়ের দ্বারা প্রশংসিত হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব হয়ে ওঠে মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব।

ক্লাবের বিকাশে প্রথম সচিব যতীন্দ্রনাথ বসুর অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি সমস্ত কর্মকর্তা ও সদস্যদের স্বার্থে তাদের প্রত্যেককে একটি সুতোয় গেঁথেছিলেন। তবে মোহনবাগানের উত্থানে উদ্বিগ্ন ও ঈর্ষান্বিত এই অঞ্চলের অন্যান্য বড় ক্লাবগুলি প্ররোচনা, উপহাস, অসম্মান এবং অবহেলার মাধ্যমে তাদের ঐক্যে চির ধরাতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে এবং ভদ্র দৃষ্টিভঙ্গিকে দুর্বল করার চেষ্টারও ত্রুটি রাখে না!

যতীন্দ্রনাথ বসু সবসময়ই খেলাধুলার বাইরের এসব ঘটনায় জড়িয়ে না পড়ার পরামর্শ দিতেন। ফুটবল খেলার মাধ্যমে মাঠেই তাদের আচরণের জবাব দেওয়ায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি এবং দেখিয়ে দিতেন যে তারা কোনও ক্ষেত্রেই কারোর কম নন, তাদের একতা ভেঙে ফেলা সহজ নয়।

মোহনবাগান ক্লাবের প্রথম একাদশ ছিল: গিরিশ বসু, প্রমথ চট্টোপাধ্যায়, শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাম গোস্বামী, শরৎ মিত্র, রামনাথ সেন, নলিন বসু, উপেন ঘোষ, এম এল বসু, মনমোহন পান্ডে, প্রভাস মিত্র এবং মণিলাল সেন। ক্লাবের ফুটবল দলের প্রথম অধিনায়ক ছিলেন মণিলাল সেন। (ক্লাবের সূচনা থেকে বর্তমান পর্যন্ত সম্পূর্ণ স্কোয়াড পাবেন আমাদের ওয়েবসাইটে।)

পড়ুন এখানে: “১৮৮৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত, মোহনবাগান স্কোয়াড”

মোহনবাগানের সর্ব প্রথম ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইডেন হিন্দু হোস্টেলের দলের বিরুদ্ধে। কিন্তু মোহনবাগান কেবল ফুটবলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না- সর্বোপরি, তারা একটি "অ্যাথলেটিক ক্লাব"। ফুটবল মরশুম শেষ হওয়ার পরে, অধিকাংশ খেলোয়াড়েরা ক্রিকেটে অংশ নিতেন। এসময়ে স্থানীয়দের একাংশ ক্রিকেটকে ঘৃণার চোখে দেখলেও মোহনবাগানের খেলোয়াড়রা তাতে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। প্রসঙ্গত ফুটবল দলের অধিনায়ক মণিলাল সেনের উদ্যোগেই ক্লাবে ক্রিকেট খেলা শুরু হয়েছিল। ক্রিকেট মরশুম শেষ হওয়ার পর তাঁরা হকিতেও জড়িয়ে পড়েন।

◾ঠিকানা পরিবর্তন :

The Laha Colony Ground at Shyampukur recently (Surajit Seal via Google Maps)

এভাবে যখন বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আরেকটি বছর অতিক্রম করে মোহনবাগান, ঠিক তখনই মাঠ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। মোহনবাগান ভিলার মাঠ অনুশীলনের জন্য ছোট অনুভূত হওয়ায় শ্যামপুকুরের বড় মাঠটির কথা ভাবা হয়। কিন্ত এই মাঠে স্থানান্তরন তখন সম্ভব ছিল না কারণ, দুখিরাম মজুমদারের এরিয়ান্স এখানেই অনুশীলন করত- যারা আবার মোহনবাগান ভিলা থেকে এসেই আলাদা দল গড়ে তুলেছিল। এসময়ে ক্লাবের কর্মকর্তারা সেই মাঠের কর্ণধার মহারাজা দুর্গাচরণ লাহার কাছে সরাসরি প্রস্তাব রাখেন মাঠটি তাদের দলকে দেওয়ার জন্য। কিন্ত সেটা করতে হলে এরিয়ান্স দলকে অন্যত্র চলে যেতে হবে। দুর্গাচরণ লাহা তাই প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু ক্লাবের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং স্বার্থ ব্যাখ্যা করার পর মহারাজ তাঁর মন পরিবর্তন করেন এবং মোহনবাগানকে জমি মঞ্জুর করেন। পাশাপাশি এরিয়ান্সের জন্য শ্যাম পার্কের মাঠ বরাদ্দ করা হয়।

ততদিনে শহরের অন্যান্য ক্লাবগুলি মোহনবাগানের উত্থানকে মেনে নিতে শুরু করেছে। বাগান সেই সময়ের সবচেয়ে বড় ক্লাব যেমন ন্যাশনাল, টাউন, এরিয়ান্স, মেডিকেল কলেজ, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আর্মি, ফোর্ট উইলিয়াম, আর্সেনাল ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্র্যাক্টিস ম্যাচ খেলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে স্থানীয় মানুষ জানতে শুরু করে মোহনবাগানের নাম।

◾বাস্তবের রুক্ষ জমি :

পরের বছর মোহনবাগান সেসময়কার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পরাক্রমশালী ইংলিশ ক্লাব, সাসেক্স রেজিমেন্টের বিপক্ষে একটি ম্যাচের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিল, যে ম্যাচে মোহনবাগান বড় ব্যাবধানে হেরে যায়। কিন্তু সেই ম্যাচ থেকে বাগানের লক্ষ্য ছিল জেতা নয়, বরং তাদের ইংরেজ প্রতিপক্ষ কীভাবে ফুটবল খেলাটা আয়ত্ত করেছিল তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা, শেখা এবং সেই কৌশল আত্মস্থ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

১৮৯২ সালের মধ্যে স্থানীয় এবং ইংরেজ- উভয় ধরনেরই একাধিক ক্লাব মিলে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (IFA) গঠিত হয়, যেখানে ডালহৌসি ক্লাবের এ আর ব্রাউন এবং বি আর লিন্ডসে, কলকাতা ক্লাবের মিস্টার ওয়াটসন এবং শোভাবাজার ক্লাবের (যেই ক্লাবকে নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বধিকারী সেই সময়ের সেরা ক্লাবে পরিণত করতে সাহায্য করেছিলেন) প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে ডুরান্ড ও ট্রেডস কাপের পরে ভারতের তৃতীয় প্রাচীনতম প্রতিযোগিতা আই এফ এ শিল্ড সূচনার সিদ্ধান্ত নেন।

সেসময়ে শোভাবাজার রাজপরিবারের ব্রিটিশদের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল এবং ১৮৯২ সালের ট্রেডস কাপের উদ্বোধনী খেলায় ইস্ট সারে রেজিমেন্টকে ২-১ গোলে পরাজিত করা প্রথম ভারতীয় ক্লাব হওয়ার ফলস্বরূপ স্থানীয় ক্লাবগুলির মধ্যে একমাত্র শোভাবাজার ক্লাবকেই স্থানীয় আই এফ এ শিল্ডে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এই ধরনের বৈষম্যের কারণে কোচবিহারের মহারাজ কোচবিহার কাপ চালু করার সিদ্ধান্ত নেন যেখানে যে কোনও ভারতীয় দল অংশ নিতে পারে।

মোহনবাগান কোচবিহার কাপের প্রথম সংস্করণেই অংশগ্রহণ করে। কিন্ত তখনও তারা ধারে ও ভারে বাকি দলগুলোর চেয়ে পিছিয়ে ছিল। কর্মকর্তারা পরামর্শ দিয়েছিলেন বাকি দলগুলোর সমতুল্য হলে তবেই কোচবিহার কাপে অংশগ্রহণ করতে। কিন্ত খেলোয়াড়রা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। শেষপর্যন্ত তাদের অনুরোধে কর্মকর্তারা কোচবিহার কাপে অংশগ্রহণের অনুমতি দিলেও তাদের আশঙ্কাকেই বাস্তবায়িত করে মোহনবাগান প্রতিটি খেলায় পরাজিত হয়ে ফিরে আসে এবং এই ফলাফলের থেকে শিক্ষা নিয়ে ধৈর্য সহকারে নিজেদের প্রস্তুত করার সংকল্প গ্রহণ করে। অনেকটা যেন wake up call-এর মতই কাজ করেছিল এই প্রতিযোগিতা।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের বছরগুলিতে মোহনবাগান ট্রেডস কাপ, কোচবিহার কাপে অংশ নিলেও সেভাবে ভালো ফল তারা করতে পারেনি। কিন্তু খেলোয়াড়রা বা কর্মকর্তারা কেউই কখনও মাথা নত করেননি, তাদের নিজেদের ক্ষমতা নিয়ে কখনও সন্দেহ ছিল না। তাদের বিশ্বাসের ভিত ছিল দৃঢ় এবং গভীরে প্রোথিত।

◾ময়দান চলো :

ততদিনে শ্যামপুকুর মাঠও ক্লাবের বিস্তৃত পরিকল্পনার জন্য খুব ছোট হয়ে গিয়েছিল। তাই মধ্য কলকাতার ময়দান অঞ্চলে একটি জমির জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন ক্লাবকর্তারা। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলের কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা পাওয়া সহজ কাজ ছিল না। বারংবার অনুরোধ, আবেদন এবং একাধিক মাসের শ্রমের পরে, মোহনবাগানের কর্মকর্তারা ১৯০০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে ভাগাভাগি করে একটি জমি পেতে সফল হয়েছিল। সেই একই বছর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অভ্যন্তরীণ ঘটনা ছিল বি এন মিত্র থেকে ক্লাবের সচিব পদ মেজর শৈলেন্দ্র নাথ বসুকে হস্তান্তর (১৮৯১ সালে যতীন্দ্রনাথ বসু সহ-সভাপতি হন, জে এন মিত্র সচিব হন। কিন্তু তাঁর কাজের কারণে তিনি এই পদের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারেননি এবং সেসময়ে বি এন মিত্রকে নিযুক্তকরা হয়েছিল) শৈলেন বাবু ছিলেন সুবেদার মেজর, যিনি পরবর্তী চৌদ্দ বছর সেই পদে আসীন ছিলেন এবং ক্লাবে একটি ফুটবল বিপ্লব নিয়ে এসেছিলেন।

তাঁর নির্দেশনায় মোহনবাগানের দ্রুত উন্নয়ন ঘটতে থাকে। শৈলেন্দ্রনাথের চরিত্রটি বাইরে থেকে নারকেলের খোলের মতো শক্ত এবং রুক্ষ ছিল, তবে ভিতর থেকে তিনি আদতে ছিলেন নারকেলের ভেতরের মতোই নরম এবং সংবেদনশীল। দল গঠনের দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। অনুশীলনে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে খেলোয়াড়দের নির্দেশ দিতেন। তাঁর আগমনে মোহনবাগানের খেলার শৈলী এবং গুণ উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি পেতে শুরু করে।

এসময়ে মোহনবাগান ক্লাব সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কঠোর সদস্যপদের মানদণ্ডও শিথিল করে, তবে এটি নিশ্চিত করা হয়েছিল যে ক্লাবের নীতিগুলি লঙ্ঘন করা হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিন বনেদী পরিবারের (যাদের উদ্যোগে ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল) পাশাপাশি আরো কিছু পরিবারের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে মোহনবাগান ক্লাব তাঁবু।

◾অপেক্ষার অবসান; প্রথম ট্রফি :

The Coochbehar Cup and the Palace of the Maharaj of Cooch Behar

আরও হতাশাজনক ফলাফলের উদ্বেগের কারণে শৈলেন্দ্রনাথ বসু প্রথমে ক্লাবকে কোচবিহার কাপে অংশ নিতে দেননি। কিন্তু ১৯০৪ সালে খেলোয়াড়রা শৈলেনবাবুর প্রিয় পাত্র অধিনায়ক রামদাস ভাদুরিকে তাঁকে রাজি করানোর জন্য অনুরোধ করলে শৈলেনবাবু রাজি হয়েছিলেন কিন্তু শুধুমাত্র এই শর্তে যে রামদাসকে কথা দিতে হবে যে মোহনবাগান যেন চাম্পিয়ন হয়েই ফিরে আসে। শৈলেনবাবুর এই ঘোষণা খেলোয়াড়ের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে। বহু বছরের অনুশীলনের পর একাধিক বিব্রতকর ও উপহাসের প্রতিশোধ নেওয়ার তৃষ্ণাও তাদের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবার খেলোয়াড়েরা প্রস্তুত ছিলেন। অনেককেই অবাক করে মোহনবাগান প্রতিযোগিতার সব ম্যাচ জেতে এবং কোচবিহার কাপ জয় করে। মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব তার প্রতিষ্ঠার পনের বছর পরে জিতল তাদের ইতিহাসের প্রথম ট্রফি। উচ্ছ্বাসে ভাসলেন ফুটবলাররা। যদিও তাদের উচ্ছ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এসময় মহারাজা দুর্গাচরণ লাহার মৃত্যুর কারণে ক্লাব একটি বড় সংকটের মধ্যে পড়ে। দুর্গাচরণ লাহা তাদের মাঠ ভিলা থেকে শ্যামপুকুর মাঠে স্থানান্তরিত করতে সহায়তা করেছিলেন, তিনি ক্লাবের প্রাথমিক পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। তাই তাঁর মৃত্যুতে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্লাবে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছিল।

তাদের প্রথম কোচবিহার কাপ জয় খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়িয়েছিল, অনেক অপমানের জবাব দিয়েছিল, তেমনি একই সঙ্গে দেখা দিয়েছিল পুরো দলের অস্তিত্ব সংকট। তীব্র মানসিক চাপের মধ্যেও মোহনবাগানের খেলোয়াড়েরা আবার ট্রফি জিতেছিলেন এবং, ক্লাবও এর ফলে তার নতুন পৃষ্ঠপোষক পেতে সক্ষম হয়েছিল।

◾সম্মুখ সমর :

(Courtesy: footballmakeshistory.eu)

সেইসময় আরও কিছু ঘটেছিল যা ভারতীয় ফুটবলে মোহনবাগানের সুনামকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলেছিল। ১৯১১ সালের গৌরব অর্জনের ছয় বছর আগে এই প্রথম মোহনবাগান একটি প্রতিযোগিতামূলক শিরোপার জন্য ইংরেজদের একটি দলের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। এটি ছিল চুঁচুড়ায় গ্ল্যাডস্টোন কাপের ফাইনাল। প্রতিদ্বন্দ্বী ডালহৌসি, যার সমস্ত খেলোয়াড়ই ছিল ইংরেজ এবং সম্প্রতি আই এফ এ শিল্ড চাম্পিয়ন। 

ফাইনালের ভেন্যুতে যাওয়ার সময় ট্রেনে মোহনবাগান দল আশ্চর্যজনকভাবে ডালহৌসির প্লেয়িং ইলেভেনের সাতজন খেলোয়াড়কে দেখতে পায়। বাগানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে থাকা শৈলেন্দ্রনাথ বসু খেলোয়াড়দের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন যে বাকি চারজন খেলোয়াড় কোথায়। একজন ডালহৌসি খেলোয়াড় উত্তর দিয়েছিলেন যে তাদের মাত্র সাতজন খেলোয়াড়ই মোহনবাগানকে হারাতে যথেষ্ট! চোয়াল শক্ত হয় তাঁর। তবে কোনো উত্তর তিনি দেননা। যদিও ম্যাচ খেলতে নেমে দেখেন ডালহৌসির এগার জন খেলোয়াড়ই উপস্থিত। ম্যাচ শুরুর তিন মিনিটের মধ্যে তারা একটি গোল করে। কিন্তু এই "তারা" ডালহৌসি ছিল না! তাঁরা ছিলেন মোহনবাগানের শক্তিশালী বাঙালি ব্রিগেড। ডোঙা দত্তের একটি দুর্দান্ত থ্রো বল ডালহৌসি ডিফেন্সকে সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত করে দেয় এবং যে বল ধরে বিজয়দাস ভাদুরি গোল করতে কোনো ভুল করেননি। ম্যাচের ফলাফল হয় ৬-১! মোহনবাগান ৬, তৎকালীন শিল্ড চাম্পিয়ন ডালহৌসি ১!

মোহনবাগান সেই বছর ভারত না হলেও কলকাতার সেরা ক্লাব হিসেবে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিয়েছিল। এই জয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মোহনবাগানের জনপ্রিয়তা হঠাৎ বৃদ্ধি পায় এবং দেশের ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী স্বার্থের সঙ্গে মোহনবাগানের সম্পর্কও খুঁজে পেতে থাকে সাধারণ মানুষ। ব্রিটিশ শাসকদের শোষণ, লাঞ্ছনা, বর্ণবিদ্বেষী ব্যবহারে যে জাতির আত্মসম্মান তলানীতে ঠেকে গেছিল তারা নিজের জীবনের একটি শক্তি হিসাবে মোহনবাগানকে দেখতে শুরু করেন। ব্রিটিশদের যোগ্য জবাব দেওয়ার ক্ষমতা খেলার মাঠ। সেই জবাবের মুখপাত্র “মোহনবাগান”।

১৯০৬-০৮ সাল থেকে পরপর তিনবার ট্রেডস কাপ, ১৯০৭ সালে কোচবিহার কাপ এবং ১৯০৮ সালে গ্ল্যাডস্টোন কাপ জয় করে মোহনবাগান আই এফ এ শিল্ডে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। রামদাস ভাদুড়ির পরে তাঁর ভাই শিবদাস ভাদুড়িকে অধিনায়কত্বের দায়ভার দেওয়া হয় এবং অধিনায়কত্ব দেওয়ার সময় শৈলেন্দ্র নাথ বসু তাকে বলেছিলেন, 'শিবু, এখন আমরা শিল্ডে খেলব। আমি তোমাকে দলের প্রধান নিযুক্ত করছি। দলের গর্ব যেন অক্ষুণ্ন থাকে, তা নিশ্চিত করাই তোমার কর্তব্য। খেয়াল রেখো আমি যেন সবার সামনে অপমানিত না হই।’

> প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে: “পথচলার শুরু: কীভাবে এবং কেনোই বা জন্ম নিলো মোহনবাগান

> দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখানে: মোহনবাগানের প্রথম দু'দশক (১৮৮৯-১৯১০)

> তৃতীয় পর্ব পড়ুন এখানে: ১৯১১’র যুদ্ধজয়

> Read EP1 in English Here: The Complete Origin Story of Mohun Bagan

> Read EP2 in English Here : The First Two Decades Of Mohun Bagan (1889-1910)

Read EP3 in English Here : The Victory of 1911

আমাদের MBFT কে ফেসবুকইনস্টাগ্রামট্যুইটারইউটিউবওয়াটসঅ্যাপ  গুগল নিউজে ফলো করুন, মোহনবাগান সংক্রান্ত সকল তথ্য সবার আগে পাওয়ার জন্য 

Previous Post Next Post