১৫ই এপ্রিল, ২০২৪: দিনটা চাইলেও সহজে ভুলতে পারবে না মোহনবাগান সমর্থকরা। ২০১৯-২০ তে আই লীগ জিতে যখন ২০-২১এ আইএসএল খেলতে এলো মোহনবাগান, সবার মনে একটাই আশা, এবারে লীগ শিল্ড ঘরে আসবে। কিন্তু ইনভেস্টর আরপিএসজি গ্রুপের 'এটিকে' প্রীতি বিমুখ করে তুলছিলো মোহনবাগানীদের। পরপর তিনটে সিজনে সমর্থকদের রোষ, টনক নড়েছিলো বাগান কর্তাদের; ২২-২৩ মরশুমে আইএসএল কাপ জিতে উঠে চেয়ারম্যান গোয়েঙ্কাবাবু যখন 'এটিকে' সরানোর ঘোষণা করছে, মোহনবাগান জনতা পেয়েছিলো মুক্তির আনন্দ! ক্লাবের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া একাধিক সমর্থক আবার ফিরে পেয়েছিলেন তাদের প্রানপ্রিয় ক্লাবকে।
এটিকে মোহনবাগান যে তিনবছর আইএসএলে খেলেছিলো, তাদের সবচেয়ে বড়ো গাঁট ছিলো নিঃসন্দেহে মুম্বাই সিটি এফসি। ম্যান সিটির 'সিস্টার ক্লাব' হওয়ার দরুন প্রফেশনালিজমের ঝাঁ চকচকে পরিবেশে সুদূর ম্যাঞ্চেস্টারের পেপ গার্দিওলার ফুটবল দর্শনের সাথে সাযুজ্য রেখেই ভারতীয় ফুটবলে নতুন অধ্যায় লিখছিলো সার্জিও লোবেরা, পরবর্তীতে দেশ বাকিংহামের মুম্বাই। এই তিন বছরে দু'দুটো লীগ শিল্ড খেতাব ঘরে তুলেছিলো তারা; ২০২০-২১ এ শেষ ম্যাচে এটিকে মোহনবাগান কে হারিয়ে যখন লোবেরা শিল্ড তুলছেন, লীগের দাবিদার মোহনবাগান তখন যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না, এভাবেও লীগ সারা যায়! এরপর যখনই মুম্বাই মোহনবাগান খেলা হয়েছে, 'সাইকোলজিক্যাল প্রেসার' কোথাও গিয়ে মোহনবাগান কে একটু হলেও নাড়িয়ে দিয়েছে।
এরপর এটিকে সরেছে, ভাগ্যও হয়তো ঘুরছিলো; ২৩-২৪ এর ডুরান্ড কোয়ার্টার ফাইনালে হুয়ান ফেরান্দো মাস্টার ক্লাস, ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবার মোহনবাগান জিতলো মুম্বাইয়ের বিপক্ষে, সাথেই ১৭ তম ডুরান্ড এলো বাগান তাঁবুতে। জেসন কামিংসের মতো সদ্য বিশ্বকাপ খেলা স্ট্রাইকার, আর্মান্দো সাদিকুর মতো আলবেনিয়ার 'কাল্ট হিরো', হেক্টর ইউস্তের মতো স্প্যানিশ সেন্টার ব্যাক, সাথেই ভারতের সেরা তিন ফুটবলার অনিরুদ্ধ থাপা, আনোয়ার আলী এবং সাহাল আব্দুল সামাদ যোগ দিলেন বাগানে; সদ্য আইএসএল কাপ এবং ডুরান্ড জেতা হুয়ান ফেরান্দো বেশ আত্মবিশ্বাসী, শিল্ড এবারে আসবেই বাগানে। শুরুটাও চ্যাম্পিয়নের মতোই হয়েছিলো, প্রথম ৫ ম্যাচে ৫টা জয়; এর থেকে ভালো আর কিই বা হতে পারে! ডিসেম্বর মাসে যখন মুম্বাই অ্যাওয়ে খেলতে যাচ্ছে বাগান, সবাই বেশ আশাবাদী, লিগ জেতার রাস্তায় কিছুটা হলেও এগিয়ে যাবে বাগান শিবির !
ম্যাচের শুরুতেই আকাশ মিশ্র'র 'রেকলেস চ্যালেঞ্জে' ১০ জন হয়ে যায় মুম্বাই, এরপরে 'সিটি কিলার' কামিংসের গোলে যখন ১-০ এগোচ্ছে বাগান, তখন সবাই ভেবেছিলো একটা 'রুটিন ভিক্ট্রি' আসতে চলেছে। তাল কাটলো কিছু সময় পর, ফেরান্দোর ট্যাকটিকাল ব্লান্ডারে ১০ জনের মুম্বাই রীতিমত ছেলেখেলা করতে শুরু করলো পুরো শক্তির মোহনবাগানের বিরুদ্ধে; প্রথমার্ধের শেষদিকে ১-১ হয়ে গেলো রেজাল্ট! দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আশীষ রাই এবং লিস্টন কোলাসোর জোড়া লাল কার্ড, এরপরে মুম্বাইয়ের গোল, যে ম্যাচে লীগ জয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো সেখানেই অনেকটা পিছিয়ে গেলো বাগান! মুম্বাই ফাড়া কাটতে কাটতেও কাটলো না! এরপর ঘরের মাঠে গোয়া এবং কেরালার কাছে হার, লীগ টেবিলের শীর্ষস্থান থেকে অনেকটা পিছিয়ে গেলো মোহনবাগান। ম্যানেজমেন্ট বিষয়টা ভালো চোখে দেখেনি; সরে যেতে হলো হুয়ান ফেরান্দো কে। দলের হাল ধরলেন মিস্টার আইএসএল; অ্যান্টোনিও লোপেজ হাবাস!
হাবাস এসেই নিয়ে এলেন ফিনল্যান্ডের ইউরোকাপার জনি কাউকো কে, বাদ যেতে হলো হুগো বুমো কে। অভিষেক সূর্যবংশীকে মাঝমাঠে জেনারেলের দায়িত্ব দেওয়া হলো, আর দীপেন্দু বিশ্বাস হয়ে উঠলেন হাবাসের মিঃ ডিপেন্ডেবল। এরপর, বাকি গল্পটা রূপকথা কেও হার মানায়! ডিসেম্বর শেষে যখন সবাই শঙ্কিত মোহনবাগান 'টপ সিক্স' এ যেতে পারবে কিনা, সেই মোহনবাগান ৪ ম্যাচ বাকি থাকতে লীগ জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করলো। হিসেব টা সহজ ছিলো, ৪টের মধ্যে ৩টে জিতলেই লীগ খেতাব বাগান তাঁবুতে! কিন্তু তখনই ছন্দ কাটলো; ওয়েন কোয়েলের চেন্নাই'এর কাছে হেরে শেষ তিনটে ম্যাচ হয়ে গেলো 'মাস্ট উইন'.. অপরদিকে নতুন কোচ পিটার ক্র্যাটকি'র অধীনে চোখ ধাঁধানো ফুটবল খেলে লীগ জয়ের দিকে এগোচ্ছে মুম্বাই।
১৪ই এপ্রিল, বাঙালির নববর্ষ! সেদিন রাতে শুতে যাওয়ার আগে হিসেবটা বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছিলো দুপক্ষের কাছেই; ১৫তে ড্র হলে লীগ জিতবে মুম্বাই, আর, মোহনবাগান কে , জিততেই হবে। এর আগে ৭ বার লীগে দেখা হলেও মুম্বাইকে কখনো হারায়নি মোহনবাগান! রাতে যখন ঘুমোতে যাচ্ছি, বারবার তাড়া করছে স্বপ্নভঙ্গের ভয়! কিন্তু, এই মোহনবাগান তো আলাদা! এরা স্বপ্নের কামব্যাক করেছে লীগ রেসে, তাই, হালকা নিদ্রায় আচ্ছন্ন মোহন জনতার স্বপ্নে সেদিন অ্যান্টোনিও হাবাস, ওরফে হাবাস দাদু হয়তো বলছিলেন " কিপ ট্রাস্ট ইন মাই ভিশন, উই উইল উইন দ্যা শিল্ড "
ছোটোবেলা থেকে অনেক জায়গায় একটা কথা শুনেছি; এটা যুবভারতী নয়, মোহনভারতী। কথার কথা থেকে যুবভারতীর মোহনভারতী হয়ে ওঠা শুরু বোধহয় ১৫ এপ্রিল ২০২৪ থেকেই.. ৭টায় কিক অফ, কিন্তু বিকেল ৪টে থেকেই স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় গিজগিজ করছে ভিড়! চারিদিকে সবুজ মেরুন অকাল হোলির প্রস্তুতি; অপেক্ষা শুধু একটা জয়ের। ম্যাচের আগে পুরো স্টেডিয়াম যখন এক সুরে 'আমাদের সূর্য মেরুন' গাইছিলো, পা কি একটু হলেও কেঁপে যায়নি পিটার ক্র্যাটকির? ম্যাচের শুরু থেকেই মোহনবাগান জেতার জন্য ঝাঁপিয়েছিলো। যখন বক্সের ধার থেকে লিস্টন কোলাসোর শট'টা গোলে ঢুকছে পূর্বা লাচেন্পা কে পরাস্ত করে, স্টেডিয়ামে যেনো শব্দকম্পের সৃষ্টি হলো! বাকি ম্যাচটা? যেমনটা একটু আগে বলছিলাম, রূপকথা! Fairy Tail! দ্বিতীয়ার্ধে যখন মুম্বাই একের পর এক অ্যাটাক করছে, একা কুম্ভ হয়ে বাগানের গড় রক্ষা করছেন বছর ৩৬এর যুবক হেক্টর ইউস্তে। সাদিকু, দিমি চাপে রাখছেন মুম্বাই ডিফেন্স কে; মুম্বাইয়ের আক্রমন সামলাতে প্রায় লেফট ব্যাক হয়ে গেছেন লিস্টন কোলাসো। চাপ কমাতে দরকার আরেকটা গোল! হাবাস ডাকলেন 'সিটি কিলার' জেসন কামিংস কে.. এরপর দিমির একটা পাস, কামিংসের বিশ্বমানের ফার্স্ট টাচ এবং যুবভারতীর আরেকবার শব্দ গর্জন... ৮০ মিনিটে মোহনবাগান ২-০ এগিয়ে; জয়, হয়তো সময়ের অপেক্ষা! কিন্তু, রূপকথার গল্প তে একটু ট্যুইস্ট থাকবেনা, তা কি হয়? ৬০,০০০ মোহনবাগানীর হৃদয় ভেঙ্গে যখন ছাঙতে ২-১ করছেন, সবার মনেই ভেসে আসছে মুম্বাইয়ের বিরুদ্ধে পুরোনো হারের স্মৃতি! অতিরিক্ত সময়ে যখন ব্রেন্ডন হ্যামিল লাল কার্ড দেখলেন এবং ম্যাচের বাকি আর ৫ মিনিট, তখন এক একটা মিনিট যেনো এক একটা ঘন্টার সমান হয়ে গেছিলো। সেদিন আর ৫-৭ মিনিট খেলা চললে হয়তো অনেক মোহনবাগানীর মাঠে বসে শেষ খেলা দেখা হতো সেটা! কিন্তু, মাঠে মোহনবাগান প্লেয়ারেরা ছিলেন অটল; মুম্বাইয়ের প্রতিটা আক্রমন আটকে যাচ্ছিলো ইউস্তে, শুভাশীষ যুগলবন্দীর কাছে... এরপর, শেষ বাঁশি বাজলো, আনন্দে কখন যে আমাদের চোখ দিয়ে জলের ঝর্না নেমেছে, তার আমরাও বুঝতে পারিনি।
মোহনবাগান, নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে, লীগের ইতিহাসে প্রথমবার মুম্বাই কে হারিয়ে লীগ শিল্ড ঘরে তুললো। অ্যান্তোনিও লোপেজ হাবাসের নামটা মোহনবাগানের ইতিহাসে অমর হয়ে গেলো। ট্রফি সেলিব্রেশনের আগে যখন পুরো স্টেডিয়াম তারস্বরে গাইছে 'শুনে যা শুনে যা খোলা রেখে কান, সবুজ মেরুন পতাকা বাতাসে টানটান', কোনো এক ফুটবল কবি ঘরে বসে লিখছেন
যতদিন থাকবে মোহনবাগান-সূর্য-চাঁদ
প্রতিটা ১৫'ই এপ্রিল বাগান জনতা বলবে, হাবাস দাদু, জিন্দাবাদ!
জয় মোহনবাগান