শ্রেষ্ঠ দল, শ্রেষ্ঠ সমর্থক: যাদের ভালোবাসা সবুজ মেরুনে ফোটে

 


"অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান জনতার মধ্যে শুরু হল গলাগলি, কোলাকুলি। কেউ কাউকে চেনে না; তবু পাশের লোককে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে, "জিতেছে, মোহনবাগান জিতেছে।" অপরিচয়ের ব্যবধান একেবারেই ঘুচে গেছে। সকলেই এই অপূর্ব আনন্দের অংশীদার। আনন্দ প্রকাশ করছে জানা কথা একে অন্যকে জানিয়ে। কথা কিন্তু একটিই- "জিতেছে, মোহনবাগান জিতেছে।” গলাগলি, কোলাকুলি করে একই কথা পরস্পরকে জানাচ্ছে। সকলেই শুনছে এবং শোনাচ্ছে।"

— পরেশ নন্দী, মোহনবাগান ১৯১১

সুকুমারের "পাস না অনার্স, দাদা?" প্রশ্নে খেলা দেখে বেরোনো ভদ্রলোক ঠিকমত প্রশ্নটা শুনতে না পেয়ে চিৎকার করে জানিয়েছিলেন "মোহনবাগান।" সিনেমার পর্দা থেকে বাস্তবের মাটিতেও এই একটা নাম যে কত মানুষের কত কিছুর উত্তর হয়ে থেকে গেছে বছরের পর বছর ধরে তার হিসেব নেই। কখনো তাদের এই উত্তরের সদর্প সঙ্গী হয়েছে ঊনত্রিশে জুলাই ১৯১১-এর ঢাক খোল কর্তাল, আবার কখনো বা আটই মার্চ ২০২৫-এর অভিনব ফায়ার ক্র্যাকার। কখনো ক্যালকাটা এফসি কিংবা ডালহৌসি মাঠ, কখনো আবার যুবভারতীর কৃত্রিম বাতিস্তম্ভ সাক্ষী থেকেছে এই জোরালো ঘোষণার। ১৩৬ বছরের প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে বারবার তার সমর্থকদের প্রকৃত অর্থেই দ্বাদশ ব্যক্তি হয়ে আবির্ভাব ঘটেছে। যার ব্যতিক্রম ঘটেনি এই ২০২৫-এ এসেও। জেমি ম্যাকলারেন, শুভাশীষ বসুরা যখন একের পর এক রেকর্ড নিজেদের ঝুলিতে ভরে নিচ্ছেন, ঠিক তখন মোহনবাগানের মুকুটে নতুন পালক যোগ করে চলেছেন সমর্থকেরা।



▪️গ্যালারির স্কোরবোর্ড: চাম্পিয়ন মোহনবাগান

পরিসংখ্যান ছাড়া ফুটবল হয় না। তাই কিছু পরিসংখ্যানের আগমন এই লেখাতেও ঘটতে চলেছে; তবে তা মাঠের বাইরের। আইএসএলের ইতিহাসের সর্বোচ্চ পয়েন্ট, সর্বোচ্চ ক্লিনশীট, সবচেয়ে বেশী ম্যাচ জেতার পাশাপাশি হোম ম্যাচে attendance-এ নিজেদের রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়েছেন মোহনবাগানীরা। পরিসংখ্যান বলছে মোহনবাগানের এবারের আইএসএলে ১২ টি হোম ম্যাচের মোট attendance ৪,২১,৯১৩। যেটা টুর্নামেন্টের রেকর্ড। অর্থ্যাত প্রতি হোম ম্যাচে গড় attendance ৩৫,৭৪৩ জন। 

তবে এর মধ্যে রয়েছে গৌহাটিতে আয়োজিত মোহনবাগানের "হোম" ডার্বিও। হঠাত করে সুদূর গৌহাটিতে ডার্বি স্থানান্তরের ফলে যেখানে উপস্থিতি ছিল মাত্র ২,৫৬৭! অর্থ্যাত সেই ম্যাচটি বাদ দিলে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে হোম ম্যাচের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৩৮,৭৫৯— যা এই মরশুমে বিশ্ব ফুটবলের নিরিখে মোহনবাগানকে এনে দিয়েছে ৫৩ নম্বর স্থানে; চেলসি, সেভিয়া, পি এস ভি, জেনিত, জার্মান ডিফেন্সিভ চাম্পিয়ন বেয়ার লেভারকুসেন, সৌদি জায়ান্ট আল ইতিহাদের মত দলের থেকেও আগে। যেখানে গত মরশুমে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কেরালার হোম ম্যাচে গড় দর্শক ১৫,৮৯৪ জন, যারা রয়েছে তৃতীয় স্থানে।

 এবারে দ্বিতীয় স্থানটি দখল করেছে ইস্টবেঙ্গল, যাদের হোম ম্যাচে গড় দর্শক সংখ্যা ১৮,৪২৩ জন। তবে নেভিল কার্ডাসের "স্কোরবোর্ড গাধা"র মত এখানে পুরো ছবিটা পরিষ্কার হয় না। আজও আমাদের দেশে কলকাতা ডার্বির উন্মাদনার কাছাকাছি আর কোনো ম্যাচ আসতে পারেনি। সেই ইস্টবেঙ্গলের হোম ডার্বিতে যুবভারতীতে attendance ছিল ৫৯,৭৮২ জন। অক্টোবরে জেমি ম্যাকলারেন এবং দিমিত্রি পেত্রাতোসের জোড়া গোলে যখন জিতছে মোলিনা ব্রিগেড, তখন গ্যালারি জুড়ে এই সংখ্যার আধিক্য যে মোহনবাগানীদেরই ছিল  সেটা বোঝার জন্য কোনো পুরস্কার নেই। এই পরিসংখ্যান বাদ দিলে ইস্টবেঙ্গলের যুবভারতীতে গড় দর্শক উপস্থিতি ১৪,৩৬৩ জন–যা কেরালার থেকে কম এবং জামশেদপুরের থেকে মাত্র ৮০ জন বেশী। এর পাশাপাশি আইএসএল কাপ সেমিফাইনালে ৫৮,১২৩ জন এবং ফাইনালে যুবভারতীতে উপস্থিত ছিলেন ৫৯,১১১ জন। অর্থ্যাত যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের গ্যালারিতে মরশুম জুড়ে শুধুই সবুজ মেরুন রঙের আঁকিবুকি কেটেছেন বাগান সমর্থকরা; লাল হলুদ যার পাশে বড্ড ফিকে।

▪️দ্বাদশ ব্যাক্তি: আজকের দিনে কতটা প্রাসঙ্গিক?

"A football match is so much more than just what takes place on the green of a football stadium— it is also the reactions of the spectators: the singing, the 'Mexican wave', the face paintings in the colours of flags..." —Franciszek Makurat (The Image of a Football Fan as Depicted in Research Literature The Image of a Football Fan as Depicted in Research Literature and the Present Study and the Present Study)

তিনটে আলাদা দলের হয়ে খেলে আইএসএল জিতেছেন গ্রেগ স্টুয়ার্ট। কিন্তু তিনটে জয়ের মধ্যে তিনি এগিয়ে রাখলেন এবারের লিগ জয়কেই। লিগ শিল্ড হাতে তুলে গ্রেগ স্টুয়ার্ট বললেন, "এত মানুষের সামনে খেলা একটা অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। এই কারণেই আমরা ফুটবল ভালবাসি। সমর্থকদের জন্যই ট্রফিটা আরও বেশি করে জিততে চেয়েছিলাম।” অনেকেই যখন মনে করেন আজকের এই চরম পেশাদারিত্বের সময়ে গ্যালারিতে দর্শকদের উপস্থিতি খেলার এবং খেলোয়াড়দের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলেনা, ঠিক তখনই এই বক্তব্যগুলোই বারবার সেইসমসস্ত কথার সারবত্তাহীনতা প্রমাণ করে। লকডাউনের সময়কার দর্শকশূণ্য গ্যালারিতে খেলার সময়ে খেলোয়াড়েরা কীভাবে হতাশা প্রকাশ করতেন তা আমাদের সকলেরই মনে আছে। 

Mohun-Bharati. Picture credits - Probudhya Guchait


স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ২০২১-এ "Never Give In" ডকুমেন্টারিতে অ্যানফিল্ডে লিভারপুলের ছ'টি ম্যাচ হারার প্রসঙ্গ তুলে এনে বলেছিলেন, "লিভারপুল নিজেদের জঘন্যতম মরশুমেও অ্যানফিল্ডে ছ'টি ম্যাচ হারেনি। বড় স্টেডিয়ামগুলোতে দর্শকদের উপস্থিতি আর অনুপস্থিতি এই পার্থক্যটাই গড়ে দেয়।" ওপরেই তুলে ধরা হয়েছে পোল্যান্ডের গাডান্স্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব স্পোর্টস সাইকোলজি বিভাগের রিসার্চার Franciszek Makurat-এর উদ্ধৃতি। যেখানে তিনি পরিষ্কার বলেছেন একটি ফুটবল ম্যাচ কখনোই শুধুমাত্র সবুজ ঘাসের ওপর বাইশজন খেলোয়াড়ের খেলা নয়, "reaction of spectators" কে নিয়েই এর পূর্ণতা।

জার্মান গবেষক এবং লেখক এলিয়াস কানেত্তি একটি অন্যরকম তত্ত্বের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, একটি ফুটবল স্টেডিয়ামকে খুব যত্ন সহকারে বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করা হয়, যার ভেতরে রয়েছে মানুষের তৈরী প্রাচীর। স্টেডিয়ামে উপস্থিত সকলেই সেই বাইরের জগতের দিকে পেছনদিক করে থাকেন। স্টেডিয়ামে আসার সময় তাঁরা বাইরের দুনিয়ায় কী ঘটছে তা নিয়ে ভাবেন না। তাঁরা তাদের সমস্ত সম্পর্ক এবং অভ্যাস পেছনে ফেলে বা বাইরে রেখে আসেন। তাঁরা একটি mass বা সমষ্টি হিসেবে মুখোমুখি বসে থাকেন। প্রতিটি সমর্থকের সামনে এবং দুপাশে হাজার হাজার তাঁরই মত সমর্থকের মাথা থাকে। স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রতিটি দর্শকের মধ্যে যে পার্থক্য, যে স্বতন্ত্রতা- তা মুছে যায়। প্রত্যেকে মিলে একটি সমষ্টি হয়ে ওঠেন, যাদের আলাদা কোনো পরিচয় নেই, আলাদা কোনো রূপ নেই! তাঁরা একটা খেলাকে কেন্দ্র করে একইভাবে নিয়ন্ত্রিত হন এবং সকলে নিজেদের অজান্তেই একইরকম আচরণ করে মাঠের খেলার সঙ্গে মিশে গিয়ে খেলাটাকে সমষ্টিগতভাবে তাদের চাওয়া অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন।

ওডিশা এফসির বিপক্ষে শিল্ড ডিসাইডার ম্যাচটির কথাই ধরা যাক। নব্বই মিনিট হয়ে গেছে কিন্ত গোলের দেখা নেই। এদিকে তিন পয়েন্ট না পেলে ঝুলে থাকবে শিল্ড জয়। গ্যালারিতে উৎকন্ঠা। সেসময় যখনই আপুইয়া একটা বল ধরছেন কিংবা শুভাশীষ বসু বা আলবার্তো রডরিগেজরা একটা আক্রমণ শুরু করার চেষ্টা করছেন তখন গ্যালারি যেন একত্রিত হয়ে তাদের মত করে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিলেন খেলার গতি প্রকৃতি। তাদের মনমতো না হয়ে কোনো খেলোয়াড় একটু বেশীক্ষণ পায়ে বল রাখলে বা একটা স্কোয়ার পাস বা ব্যাকপাস করলে তাদের ধৈর্যের বাধ ভাঙছিল। আক্রমণ হতেই তাদের সমশ্বর চিৎকার এবং বিপক্ষ সেই আক্রমণ থামিয়ে দিতেই ডেসিবেল পড়ে যাওয়া—এতে প্রভাব পড়ে মাঠের দু'দলের ওপরেই।

বিপক্ষের খেলোয়াড়ের ওপর "বু" ঘাবড়ে দিতে পারে তাদের। অক্টোবরে প্রথম ডার্বিতে মোহনবাগান থেকে চুক্তির আনজাস্ট টার্মিনেশনে ইস্টবেঙ্গলে সাইন করা খেলোয়াড় বল ধরলেই যেভাবে অর্ধেক যুবভারতী "বু" করছিল তা অনেক অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের মনোবলও ভেঙে দিয়ে তাকে ভুল করতে বাধ্য করতে পারে। মোহনবাগানের লিগের শেষ ম্যাচে বরিস এবং হৃত্বিকের মিসকমিউনিকেশনে গোয়া যে গোলটা খেল, সেটাতেও এই দ্বাদশ ব্যক্তির ভূমিকা আছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। তবে হ্যাঁ, সব কিছুর মতই এসবেরও ব্যতিক্রম আছে।

গ্যালারিতে সমর্থকেরা হাজির করলেন মোহনবাগানের ম্যাসকট বাগ্গুকে। ছবি: রৌণক কর।


এমনকি থিয়েটারের দর্শকদের সঙ্গে খেলার দর্শকদের পৃথথীকরণ করে পোলিশ লেখক J.Z. Jakubowski বলেছেন যে, একটি খেলা কখনোই একজন প্রকৃত ক্রীড়াপ্রেমীকে নিশ্চুপ বা উত্তেজনাহীন রাখে না। থিয়েটারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। আমাদের হয়তো থিয়েটার প্রযোজনা পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু খেলার ক্ষেত্রে যদি আমাদের খেলাটা ভালো নাও লাগে তবুও আমরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে পারি। সমর্থকদের এই সক্রিয় চরিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটা আবেগের বিস্ফোরণ ঘটায় যা তাদের প্রিয় দলের পক্ষে সৃজনশীলতার জন্য সহায়ক, আর এটিই থিয়েটারের দর্শকের সঙ্গে খেলার দর্শকদের মূল পার্থক্য। একটি ফুটবল দলের সমর্থকেরা দাবী করতেই পারেন, "আমরা নিষ্ক্রিয় নই, আমরা নিজেরাই (গ্যালারিতে) একটা ইভেন্ট তৈরি করি।"

অর্থ্যাত আজকের দিনেও ফ্যানেরা যে দ্বাদশ ব্যক্তি হতে পারেন এবং হয়ে ওঠেন এবিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। অভিনব টিফো, রঙিন স্মোক, পায়রো শো, নব্বই মিনিট ধরে মেগাফোনে স্লোগান, চ্যান্ট— যেকোনো মাঠে একটা নৈসর্গিক পরিবেশ এবং বিপক্ষের জন্য নরকসুলভ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে; আর পুরো মরশুম ধরে ঠিক যেটা মোহনবাগানীরা করে গেছেন অবিরাম।

▪️টিফো বিপ্লব, টিফোয় বিপ্লব

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ফুটবল ক্লাবে এত ফুটবলাররা খেলে চলেছেন। কত ক্লাব আর তাদের হাজার হাজার ফুটবলার। কত ফুটবলার নিজের প্রিয়জনদের ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন সুদূর বিদেশে। খেলার টানে, জীবিকার টানে। হয়তো তাদের অনেকরই প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হয় নয়-দশ মাস পর, আস্ত একটা মরশুম শেষ হলে পরে। এইতো সেদিন এ-লিগের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোল স্কোরার জেমি ম্যাকলারেন ভারতে আসার আগে নিজের সোসাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে ওঁর স্ত্রীর দেওয়া একটি ছবি শেয়ার করলেন যাতে জেমির কাঁধে ওঁর নয় মাসের মেয়ে। সঙ্গে যা লেখা তার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "নতুন একটি অধ্যায় শুরু হল। এই খেলাটা বড়ই অদ্ভুত! এটা তোমাকে যেমন সব কিছু দিতে পারে তেমনি তোমাকে তোমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মানুষগুলোর থেকে দূরেও সরিয়ে রাখতে পারে। এর জন্য কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ, সাহস দরকার হয়...আনটিল উই সি ইউ এগেইন। অল দ্য বেস্ট মাই লাভ।" বিষয়টা যেন নাড়া দিয়ে যায় জাতীয় ক্লাবের এক ফ্যান্সক্লাব মেরিনার্স এরিনাকে।

তেইশে নভেম্বর মোহনবাগানের বর্তমান দলের ছয় বিদেশী ফুটবলার এবং তাদের প্রিয়জনদের ছবি দিয়ে যুবভারতীতে উন্মোচিত হয় ১২,৬০০ বর্গফুটের এশিয়ার বৃহত্তম টিফো। যেখানে দেখা যায় মোহনবাগানের ছয় বিদেশী তাদের প্রিয় মানুষগুলোকে ছেড়ে আসছে তাদের দ্বিতীয় পরিবারে, মোহনবাগান পরিবারে; আর মোহনবাগানীরা আনন্দের সঙ্গে তাদের স্বাগত জানাচ্ছে মাতৃসম ক্লাবে। সঙ্গে ব্যানারের মাধ্যমে বার্তা "Not Foreigners But Family"। শুধু আকারেই নয়, ভাবনাতেও যেন এই টিফো অনন্য। মোহনবাগান ছাড়িয়ে এই বার্তা যেন পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে থাকা ছোট বড় মাঝারি সমস্ত ক্লাবের সেই সমস্ত ফুটবলারকে যারা পরিবারকে ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় এসে পেয়েছেন তাদের নতুন ঘর—হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম।

ইতালীয় শব্দ "টিফোসি" (Tifosi) থেকে জন্ম "টিফো" কথাটির, যার বুৎপত্তিগত অর্থ "যারা জ্বরে আক্রান্ত।" সত্যিইতো এই পাগল সমর্থকেরা তো একটা জ্বরেই আক্রান্ত! ফুটবল জ্বর। ছয়ের দশকের শেষ দিকে ইতালি এবং দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে ফুটবলে টিফো কালচার শুরু হওয়ার বহু বছর পর্যন্ত ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত ছিলেননা একেবারেই। ২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়টাকে ভারতীয় ফুটবলে ফ্যান্স ক্লাব রেভলিউশনের সময় বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে, আর এসময়েই ভারতীয় ফুটবল পরিচিত হয় টিফো নামক বিষয়টির সঙ্গে। বিশালাকার ব্যানারে ফুটে ওঠে দলের ইতিহাস, বিপক্ষের প্রতি শ্লেষ, ম্যানেজমেন্ট বা ফেডারেশনের দুর্নীতির প্রতিবাদ থেকে সামাজিক বার্তা কিংবা কোনো স্মরণীয় ব্যক্তিকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। প্রিন্ট এবং হ্যান্ড-পেইন্টেড: মূলত এই দুইভাবে ফ্যানেদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরী হয় এই বিশালাকার টিফো গুলি।



এই টিফো কালচারেও মোহনবাগানীরা দশ গোল দিয়েছেন তাদের সমস্ত বিপক্ষকে। ২৭ শে জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে লিস্টন কোলাসোরা যখন 'মাস্ট উইন' ম্যাচে মাঠে ঢুকছেন সুনীল ছেত্রীদের বিপক্ষে, তখন তাদের চোখ আটকে গিয়েছিল মাঠের বাঁদিকে। বি-টু গ্যালারিতে মেরিনার্স বেস ক্যাম্পের ৩৪০ ফুট দীর্ঘ এবং ৭৫ ফুট চওড়া টিফোতে ছিল ১৯১১-এর শিল্ড জয়ের গল্পগাঁথা। টিফোটির বামদিক থেকে ডানদিকে ধীরে ধীরে চোখ নিয়ে গেলে যেন একটা আস্ত উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে। 

রক্ষিত হবে আস্ত একটা সময়ের দলিল। টিফোটিতে দেখা যাচ্ছে প্রথমে ব্রিটিশদের হাতে ভারতীয়দের লাঞ্ছিত হওয়ার দৃশ্য, এরপরেই মোহনবাগানের যোদ্ধাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার দৃশ্য এবং শেষে ব্রিটিশ দলকে হারিয়ে উঠে শিল্ড নিয়ে মোহনবাগানের অমর একাদশের চিত্র, যাদের পেছনে নেমে যাচ্ছে ইউনিয়ন জ্যাক এবং ওপরে উঠছে ভারতের তেরঙ্গা। গ্যালারিতে তাঁরা হাতে লেখা সুবিশাল ব্যানারও রাখেন, যেখানে লেখা: "OUR LEGACY ISN'T JUST HISTORY BUT THE HEART BEAT OF A NATION OF PATRIOTS."



সুবিশাল এই টিফো তৈরীর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, সদিচ্ছা, এবং ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা। তিন সপ্তাহ ব্যাপী দিন রাত এক করে কাজ করেছেন মেরিনার্স বেস ক্যাম্প এবং তাদের বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েট ফ্যান্স ক্লাব এবং আর্ট কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা। সুবিশাল এই মহাযজ্ঞে শামিল হতে বেশ কিছু মোহনবাগান সমর্থক স্বেচ্ছাশ্রম দান করতে ভারতের অন্য প্রান্ত থেকেও এসে হাজির হন। তাঁবু খাটানো, রাতে পাহাড়ার ব্যবস্থা করা, ছেলেদের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত, বিদ্যুতের জোগান, কাপড়, রঙের খরচ– এই বিশালাকৃতি টিফোটি তৈরী করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৭.৫ লক্ষ টাকা। 

প্রায় পঞ্চাশ জন ছেলে মেয়ে হাতে এঁকে ফুটিয়ে তুলেছেন ভারতের জাতীয় ক্লাব মোহনবাগানের গৌরবগাঁথা; যা যুবভারতীর বুকে স্থান পেয়ে গড়ে নিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম হাঁতে আঁকা টিফোর বিশ্বরেকর্ড! হ্যাঁ, সুইডিশ ক্লাব আইএফকে নরশপিংয়ের থেকে রেকর্ড ছিনিয়ে নিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম হাতে আঁকা টিফোর বিশ্বরেকর্ড গড়ে তুলেছেন আমার আপনার মত কয়েকজন মোহনবাগান অন্ত প্রাণ ছেলে মেয়ে।

একশো বছরেরও বেশী সময় ধরে যেমন অনেক বাঁধা বিপত্তি এলেও মোহনবাগান ঠিক "ডিফেন্স চেরা পাসে" বিপদকে "ফাঁকি" দিয়েছে, তেমনি যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের গঠনও টিফো উন্মোচনের ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি মোহন মায়ের দামাল ছেলেদের কাছে। ভারতের বৃহত্তম 3 D টিফো এই যুবভারতীর গ্যালারিতেই উন্মোচিত করেছে মেরিনার্স ডি এক্সট্রিম। আইএসএলের প্রথম ম্যাচে এই অভিনব টিফো আলোড়ন ফেলে দেয় ভারতীয় ফুটবল মহলে। তবে তাঁরা এখানেই থেমে থাকেননি, লিগের শেষ ম্যাচেও দুটো লিগ শিল্ড নিয়ে জেসন কামিংসের আদলে জোকারের প্রতিকৃতি তৈরী করে আরো একটি অসাধারণ 3 D টিফোর সাক্ষী করেন আমাদের।



পুরো মরশুম ধরে এরকম অগণিত টিফোতে ঢেকে গেছে মোহনভারতী। মোহনবাগানীদের তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে মোহনবাগানের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থেকে দীপ্পেন্দুর মত আগামীর পতাকা বাহকেরা। কোনো টিফোতে তিনটি সম্পূর্ণ আলাদা সময়ের তিন বাঙালী ডিফেন্ডার তথা ঘরের ছেলে গোষ্ঠ পাল, সুব্রত ভট্টাচার্য এবং শুভাশীষ বোসকে সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে, আবার কোনো টিফো সগৌরবে ঘোষণা করেছে "তোমরা দ্বিতীয় স্থানের জন্য লড়াই করো। প্রথম স্থানটা আমাদের জন্যেই সংরক্ষিত।" কোনো টিফোতে আবার পড়শী রাজ্য ওড়িশার সঙ্গে রসগোল্লা যুদ্ধকে এনে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে রসগোল্লা আসলে কাদের। সঙ্গে "গঙ্গাপাড়ে মিষ্টির হাড়ি, শিল্ড ফিরলো নিজের বাড়ি" ট্যাগলাইন ম্যাচের এবং গ্যালারির আবেদনকে একটা আলাদা মাত্রা দিয়েছে। কোনো টিফোতে শুভাশীষ বসুর বলা "We are the king of this jungle. This is our jungle" স্থান পেয়েছে উপযুক্ত থিমের সঙ্গে, তেমনই মোহনবাগানের বর্তমান হার্টথ্রব পেত্রাতোসের যে "ক্লাস ইজ পার্লামেন্ট, ফর্ম ইজ টেম্পোরারি"- সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন সমর্থকেরা। শৈলেন মান্নার শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, প্রাচীর হয়ে ওঠা মোহনবাগানের ডিফেন্সকে ট্রিবিউট, কেরালা ম্যাচে মোহনবাগান খেলে যাওয়া বর্তমান এবং প্রাক্তন কেরালার ফুটবলারদের নিয়ে তৈরী টিফো- এই সবকিছুই মোহনবাগানীদের গঠনমূলক চিন্তাধারা, শৈল্পিক দক্ষতা এবং দলের প্রতি নির্ভেজাল ভালোবাসার ছাপ রেখে যায়।

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে খোঁচা দেওয়া থেকেও বিরত থাকেনি তাঁরা। ডার্বিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি এঁকে মোহনবাগানকে খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করা হলে মোহনবাগান গ্যালারি থেকেও পাল্টা টিফো করা হয় ওই ম্যাচেই, যেখানে সবুজ মেরুন পাঞ্জাবীতে সুসজ্জিত মহানায়ক সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলছেন, "ভানু দা, তোমার দলের আই লিগ আর আইএসএল লিগের সংখ্যা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম।" গৌহাটি ডার্বিতে দেখা গেছে মোহনবাগানকে "ডন" এবং ইস্টবেঙ্গলকে "ঢাকাইয়া মস্তানের" সঙ্গে তুলনা করে মরশুমের শুরুতে ট্রান্সফার মার্কেটে ঝড় তুলে জনৈক ফুটবলারের মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গলে যোগ দেওয়ার পরে বলা "বহুত জাদা ডিফারেন্স হ্যায়" লিখে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের পার্থক্য। স্বামী বিবেকানন্দ, মাদার টেরিসা, এবং এপিজে আব্দুল কালামের প্রতিকৃতি এঁকে পড়শী দেশ বাংলাদেশের অরাজগতা নিয়ে বার্তাও দেওয়া হয়েছে টিফোর মাধ্যমে। আবার ভিশাল কাইথ যে এই মুহূর্তে তর্কাতীতভাবে ভারতের এক নম্বর গোলরক্ষক এবং তিনি জাতীয় দলের প্রথম একাদশ ডিজার্ভ করেন, সুবিশাল টিফোর মাধ্যমে সেটিও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে জাতীয় দলের কোচকে। ডঃ সঞ্জীব গোয়েঙ্কার "সঞ্জীবনী সুধা"য় যে তিনি মোহনবাগানে "এলেন, দেখলেন, জয় করলেন", সেই বার্তাও টিফোর মাধ্যমে তুলে ধরতে ভোলেননি বাগান সমর্থকেরা। "জীবনের রঙ সবুজ মেরুন"-এর একাধিক টিফোতে আবির্ভূত হয়েছেন জেসন 'দ্য জোকার' কামিংস।

মোহনবাগানীদের ভারতীয় ফুটবলে টিফো সংস্কৃতিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া দেখে কোনো কবির কলম কবিতা লিখবে কিনা জানা নেই, তবে এই মরশুমের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের বুকে কেউ খাতা কলম ট্যাব কীপ্যাড ব্যবহার না করেই যেন গেঁথে দিয়ে গেছেন অসংখ্য কবিতার কোলাজ। রেকর্ড বুক বলছে মোহনবাগানীরা টিফোর ক্ষেত্রে এই মরশুমে করে ফেলেছেন একাধিক ঈর্ষণীয় রেকর্ড:

১) পৃথিবীর বৃহত্তম হাতে আঁকা টিফো (২৫,৫০০ বর্গফুট)। [২৭/০১/২০২৫]
২) প্রিন্ট এবং হাতে আঁকা মিলিয়ে এশিয়ার বৃহত্তম টিফো (১২,৬০০ বর্গফুট)। [২৩/১১/২০২৪]
৩) ভারতের বৃহত্তম থ্রি-ডি টিফো। [১৩/০৯/২০২৪]
৪) প্রতিটি হোম ম্যাচে অন্তত একটি টিফো।
৫) একটি ম্যাচে সর্বাধিক সংখ্যক টিফো (দশটি)। [০৮/০৩/২০২৫]
৬) ভারতীয় যে কোনো লিগে একটি দলের একটি মরশুমে সর্বাধিক সংখ্যক টিফো।
৭) আইএসএল তথা ভারতের যে কোনো লিগে একটি দলের সর্বাধিক সংখ্যক ম্যাচে টিফো।       
৮) এক মরশুমে অ্যাওয়ে ম্যাচে এবং হোম গ্রাউন্ডের বাইরে সর্বাধিক সংখ্যক টিফো।

এই টিফো সংস্কৃতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মত "আঙুর ফল টক" জাতীয় কথা নেই, নিজেদের দলের এবং ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতা ঢাকতে রাইভাল দলের ইনভেস্টরকে টেনে বিলো দ্য বেল্ট আক্রমণ এবং ভিত্তিহীন কথার চাষ নেই; সেখানে রয়েছে সংখ্যায়, আকৃতিতে, অভিনবত্বে এবং বিষয়বস্তুর বিস্তৃতিতে যুবভারতীর মোহনভারতী হয়ে ওঠার গল্প।

▪️নাইনটি মিনিটস্ ইন যুবভারতী:

"চল রে দল বেঁধে চল ময়দান
মোহনবাগান করে আহ্বান।"

ওরা মোহনবাগানের আহ্বানে দল বেঁধে ময়দানে যায়, গলা চিরে গান করে, জয়ের আনন্দে চোখের জল ফেলে। আইএসএলের পরিসংখ্যান বলছে এই মরশুমে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে অপরাজিত হোসে মোলিনার মোহনবাগান। ১৫ টি ম্যাচ খেলে ১৪ টি জয়, ১ টি ড্র। গোল করেছে ৩৫ টি, বিপক্ষে গোল সাতটি। ক্লিনশীট ১১ টি। এরকম ঈর্ষণীয় হোম performance-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাঠের পাশাপাশি গ্যালারিতেও একটা অনন্যসাধারণ পরিবেশের সৃষ্টি করে গেছেন মেরিনাররা প্রতি ম্যাচে। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মোহনবাগানের এই মরশুমে আইএসএলে গড় দর্শক সংখ্যার কথা আগেই বলা হয়েছে। তাদের বিক্রমে এ যেন সত্যিই হয়ে ওঠে "Heaven for us, Torment for opponents."!

কোল্ড স্মোক থেকে পায়রো, সবুজ মেরুন রঙ মশাল থেকে ফায়ার ক্র্যাকার—মোহনবাগানীদের পাগলামো একটা অদ্ভুত মোহাচ্ছন্ন করে রাখে অনূর্ধ্ব সতেরো বিশ্বকাপের সাক্ষী এই স্টেডিয়ামকে। পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার মানুষের গর্জন, আল্ট্রাসদের সবুজ মেরুন আতসবাজি ইউরোপের কোনো গ্যালারির সঙ্গে গুলিয়ে দেয় আমাদের। শিল্ড হাতে তোলার দিন ম্যাচ শেষে মেরিনার্স বেস ক্যাম্পের অভিনব ফায়ার ক্র্যাকার ভারতীয় ফুটবল আগে দেখেনি। সেখানে ফ্যান্সক্লাবদের নাম লেখা ব্যানারের গ্যালারি দখলের প্রতিযোগিতা ছাপিয়ে প্রাধান্য পায় মোহনবাগানীদের দৃঢ় স্টেটমেন্ট—"ভারতসেরা মোহনবাগান।" মরশুমের শুরুতে গ্যালারি মনে করিয়ে দেয় "Tu zinda hai tu zindagi ki jeet par yakeen kar"; আর মরশুম শেষের বলিষ্ঠ ঘোষণা "Unleash the fury, unleash the pride; Mohun Bagan — Champions in every stride."

"কর্টেও" এগিয়ে চলে। গ্যালারির সীট ভর্তি হতে থাকে। মিলে মিশে যায় যুবভারতীর কাছে পরিচিত আর অপরিচিত হাজার হাজার মুখ। ইউরোপীয় কোনো এক গ্যালারির সঙ্গে গুলিয়ে যায় বেস ক্যাম্প জোন। দীপেন্দুরা মাঠে নামতে নামতে গলা মেলান "আমাদের সূর্য মেরুনে"। আশীষ রাই বলে ওঠেন, "এই বিপুল দর্শক দেখে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।" কৃত্রিম বাতিস্তম্ভগুলো স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওরাও যেন বলতে চায় "90 minutes in VYBK is a very long time, even the wildest of lions can be tempted!"

▪️ম্যানেজমেন্টের ভূমিকা:

এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যায় এই পয়েন্টটা বাদ চলে গেলে। ২০২৩ থেকে মোহনবাগান সুপার জায়েন্ট ম্যানেজমেন্টের মোহনবাগানের আল্ট্রাস গ্রুপগুলো এবং বিভিন্ন ফ্যান্স ক্লাব গুলোকে একই ছাতার তলায় আনতে পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিছু নির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ করলে তাদেরকে "অফিশিয়াল" ফ্যান্স ক্লাবের আওতায় আনার কাজ শুরু হয় যাতে তাদের গ্যালারি কর্মকান্ড আরো সহজতর হতে পারে। ম্যাচ ডে তে যুবভারতীর মোহনভারতী হয়ে ওঠার পেছনে একটা বিশাল ভূমিকা যে পালন করে ফ্যান্স ক্লাব গুলো এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। টিফো, ব্যানার, স্মোক, পায়রো, ড্রাম, মেগাফোন গ্যালারিতে ঢোকানোর জন্য লিগ কমিটির এবং পুলিশের অনুমতি গ্রহণ করা থেকে, ফ্যান্স ক্লাব বাঁধাপ্রাপ্ত হলে ম্যানেজমেন্টের সাহায্যের হাত সবসময়ই থাকে সমর্থকদের জন্য। পড়শী দলের সমর্থকদের এবং বিভিন্ন ফ্যান্স ক্লাবকে যখন এসব বিষয় নিয়ে ক্রমাগত অভিযোগ করে যেতে দেখা যায় একই মাঠের ক্ষেত্রে, তখন আমাদের ম্যানেজমেন্টের দূরদর্শিতার দিকটিই প্রকট হয়ে ওঠে।



এর পাশাপাশি যুবভারতীতে ম্যাচ দেখতে হলে একটা সমস্যায় পড়তে হয় দর্শকদের। রাজ্য সরকারের অধীনস্থ স্টেডিয়াম হওয়ায় যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে অনুষ্ঠিত খেলায় প্রয়োজন রাজ্য সরকারের স্টাম্প; আর সেই কারণে অনলাইনে টিকিট কাটলেও থেকে যায় টিকিট রিডিম করার একটা অতিরিক্ত কাজ, যেই টিকিট রিডিম অনেক সময়েই ম্যাচ ডে তে করা যায় না অথবা কিক অফের অনেক্ষণ আগেই বন্ধ হয়ে যায়। 

এই সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে ফ্যান্স ক্লাব গুলোকে নিয়ে এই উদ্যোগ গ্রহণ করার পর। তারা সরাসরি ক্লাব ম্যানেজমেন্টের থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যার টিকিট কিনে নিজেদের সদস্যদের ম্যাচের আগে ক্রীড়াঙ্গনের বাইরেই দিতে পারে নিজেদের সময় সুযোগ মত। আর এই কারণেই দূর দূরান্তের বহু সমর্থকের টিকিট জনিত সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছে। মোহনবাগানও ছিল, তার সঙ্গে আবেগও ছিল; সেই আবেগকেই অক্ষত রেখে একটা পেশাদারিত্বের মোড়কে মুড়িয়ে উপস্থাপন করার জন্য বর্তমান ম্যানেজমেন্টকে সাধুবাদ দিতেই হয়।

মোহনবাগানের সপ্তম লিগ এল ষষ্ঠ লিগের পরের বছরেই। এই প্রথম পরপর দুই মরশুম লিগ এল মোহনবাগানে। সঙ্গে হল ঐতিহাসিক "ডাবল"। আর এই স্মরণীয় মরশুমকে খেলোয়াড়, সাপোর্ট স্টাফদের পাশাপাশি সমর্থকেরা করে তুললেন অবিস্মরণীয়। ওড়িশার বিপক্ষে "দিমিগডের" বাঁপায়ের শট অমরিন্দরকে দাঁড় করিয়ে জালে জড়াতেই আবেগের বাঁধ ভাঙল। যেমন আবেগের বাঁধ ভাঙল গতবারের কাপ ফস্কানোর জ্বালা মুছিয়ে দিয়ে জেমি ম্যাকলারেনের ছিয়ানব্বই মিনিটের গোলে। গ্যালারিতে তখন কারোর কোনো আলাদা পরিচয় নেই। তারা সবাই এক। তারা সবাই মোহনবাগান। "তারা এখন ঘর ভুলেছে, বাড়ী ভুলেছে। তাদের মন জুড়ে বসেছে মোহনবাগান। তারা এখন কাছ থেকে একবার দেখতে চায় বিজয়ী বীরবৃন্দকে। বলতে চায়, 'তোমরা আমাদের সার্থক করেছ। তোমরা আমাদের প্রাণের আনন্দ।' " (পরেশ নন্দী, মোহনবাগান ১৯১১)।

শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা ছিনিয়ে নেওয়ার তৃষ্ণা মোহনবাগান আর মোহনবাগানীদের করে তুলেছে ব্যতিক্রমী। ঊনত্রিশে জুলাই ১৯১১-এর ফাইনালে যারা মাঠের পাশে ভিড় করেছিলেন, ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন, খোল কর্তাল ঢাক ঢোল নিয়ে একটা উৎসবে মেতে উঠেছিলেন, শপথ নিয়েছিলেন "আজ আমরা ঝড় ওরা খরকূটো", ভারত তথা এশিয়া ফুটবলের অলিখিত প্রথম আল্ট্রাস ওঁরাই। সময় বদলেছে। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। খোলনচে বদলে কর্পোরেট পৃথিবীতে পা দিয়েও বদলায়নি মোহনবাগান। বদলায়নি মোহনবাগানীরা। 



জেসন কামিংসেরা যখন জালে বল জড়াচ্ছেন, তখন মোহনবাগানের এই সমর্থকেরা কোনো এক মায়াজালে জড়িয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নিজেদের শক্তি উজাড় করে দিচ্ছেন গ্যালারিতে কিংবা গ্যালারির বাইরে। তারাই নতুন করে উসকে দিচ্ছে বাংলার ফুটবলে মরে যেতে বসা আবেগকে। সুকুমারের প্রশ্ন সঠিকভাবে শুনতে না পেয়ে জনৈক ভদ্রলোক উত্তর দিয়েছিলেন "মোহনবাগান"। মোহনবাগানই আজ ভারতীয় ফুটবলে বাংলার একমাত্র উত্তর। সোনি নর্ডে থেকে জেমি ম্যাকলারেন — সময়টা বদলাচ্ছে খুব দ্রুত; আর সেই সঙ্গে ফুটবলের তৃতীয় বিশ্বের শতাব্দীপ্রাচীন একটা ক্লাবের সত্ত্বাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরছে তাদের অগণিত সমর্থক; সাদা কালো পৃথিবীতে যাদের ভালোবাসা আজও সবুজ মেরুন হয়ে ফোটে।


Follow MBFT on TwitterFacebookInstagramYoutube, TelegramWhatsapp & Google News to stay updated with all the Mohun Bagan & Indian Football related News & Updates. Jai Hind Jai Bharat! Joy Mohun Bagan!

2 Comments

  1. What a write up, pore gaye kata dilo. Joy Mohunbagan, Keep Spreading Mohunbaganisam -- Ujjwal

    ReplyDelete
    Replies
    1. Thanks. Joy Mohun Bagan. ---Sagnik

      Delete
Previous Post Next Post