বঙ্গ তনয়দের হাত ধরে, শিল্ড ফিরলো গঙ্গাপাড়ে!
![]() |
Pic Courtesy : Indian Super League Media |
মোহনবাগান - ভারতের জাতীয় ক্লাব, কিন্তু, ১৩৫ বছরের ইতিহাসে, বা, বলা ভালো ১৯৯৬-৯৭ মরসুমে জাতীয় লীগ চালু হলে, মোহনবাগান ক্লাবের ইতিহাসে কখনো পরপর ২বার লীগ জেতেনি!
এই অবিস্মরণীয় কৃতিত্বে যতটা অবদান একজন জোসে মোলিনা, জেমি ম্যাকলারেনের, ঠিক ততটাই কিছু বঙ্গতনয়ের, যাঁরা পর্দার সামনে এবং আড়ালে থেকে মোহনবাগান কে এনে দিয়েছেন ভারতসেরার শিরোপা। আজকের MBFTর এই প্রতিবেদন, তাদের'ই সম্মান জানিয়ে!
চলুন, দেখে নেওয়া যাক:
শুভাশীষ বোস:
মোহনবাগান তার ইতিহাসে অনেক কৃতি বাঙালি সন্তান কে অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছে, তবে, আধুনিক যুগের বাগানে শুভাশীষ বোস যে ছাপ রেখে যাচ্ছেন, তা অনেকের কাছেই ঈর্ষনীয়! অধিনায়ক হওয়ার পরেই ডুরান্ড কাপ জয়, বাগানে প্রথমবার (আইএসএল) শিল্ড আনা, আবার ডুরান্ডের ফাইনাল খেলা এবং শেষমেষ শিল্ড কে রেখে দেওয়া; অধিনায়ক বোস তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতায় মুগ্ধ করেছেন সবাইকে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল এবং অ্যাসিস্ট, শুভাশীষ বোস কে করে তুলেছে গোল্ডেন বল-এর দাবীদার!
দীপ্পেন্দু বিশ্বাস:
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর! আইএসএল শিল্ড ডিফেন্সের শুরুতে যখন আনোয়ার আলী মোহনবাগান ছাড়েন, তখন সবুজ মেরুন সমর্থকদের মাথায় হাত; কোনো প্রথমসারির ভারতীয় সেন্টার ব্যাক ছাড়া মোহনবাগান শিল্ড রাখবে কীভাবে? উত্তরের জন্য বিশ্বাসেই আস্থা রেখেছিলো ম্যানেজমেন্ট! এরপরে, দীপ্পেন্দুর উত্থান দেখেছে ভারতীয় ফুটবল। দরকারে সেন্টার ব্যাক, লেফট ব্যাক, রাইট ব্যাক- ডিফেন্সে যেখানে দরকার পড়েছে, দীপ্পেন্দু সেখানে বুক চিতিয়ে খেলে দিয়েছে! ১ টি গোল, ২ টি অ্যাসিস্ট; দীপ্পেন্দু আবার প্রমান করেছে, 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর!'
বাস্তব রায়:
বাঙলা ফুটবলে এখন কোচের আকাল, একজন সঞ্জয় সেন এবং শঙ্করলাল চক্রবর্তী কে বাদ দিলে সেভাবে বাঙালি ট্যাকটিকাল মাস্টারমশাই কে ভারতীয় ফুটবলের মূলস্রোতে সেভাবে দেখা যাচ্ছেনা। এখানেই উঠে এসেছেন বাস্তব রায়! বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে মোহনবাগানেই আছেন বাস্তব এবং কাজ করেছেন হাবাস, হুয়ানের সহকারী হিসেবে। গত মরশুমে বাস্তব দায়িত্ব নিয়েছিলেন রিজার্ভ দলের। কলকাতা ডার্বিতে ৫গোল খুব বিরল, তবে বাস্তবের ছেলেরা ইস্টবেঙ্গল রিজার্ভ কে ৫-১ গোলে হারিয়ে বাস্তবের ফুটবল শৈলীর প্রমান দিয়েছিলো। এবারে মোলিনার হাত ধরে মোহনবাগানের ভারতীয় ব্রিগেড বেশ উন্নতি করেছে! আর, এর পিছনে বাস্তবের ভূমিকা অনস্বীকার্য!
অভিনন্দন চ্যাটার্জি:
মোহনবাগানের 'লাকি চার্ম'! মোহনবাগান সমর্থকদের মাঝে কান পাতলেই শোনা যায় তাদের 'অভি'দা-র নাম। ২০১৪-১৫য় মোহনবাগানে আসার পর অভিনন্দন চ্যাটার্জি এবং মোহনবাগান হয়ে গেছেন সমার্থক। অধুনা ফুটবলে যখন পরের পর ম্যাচ খেলতে হয়, দলের 'মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট'এর গুরুত্ব টা অনেকগুনে বেরে যায়; সেখানেই অভি'দা-র কৃতিত্ব! দলের 'হেড ফিজিয়োথেরাপিস্ট এবং স্ট্রেন্থ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কো-অর্ডিনেটর' হিসেবে এই লম্বা শিল্ড অভিযানে মোহনবাগান প্লেয়ারদের ফিট রাখতে ভূমিকা নিয়েছেন অভিনন্দন। ২০১৪-১৫এ বাগানে আসার পর আইলীগ, ফেড কাপ, কলকাতা লীগ, সিকিম গভর্নর্স গোল্ড কাপ, আইএসএল কাপ, ডুরান্ড কাপ এবং ২টি লীগ শিল্ড; ময়দানের অনেক ফুটবল ক্লাবের থেকেও বেশি ট্রফি জিতেছেন বাগান জনতার 'লাকি চার্ম'।
কিংশুক ভুঁইয়া:
বাগানের 'ফিজিও' বিভাগের আরেকজন সদস্য কিংশুক, যিনি পর্দার পিছনে থেকে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস। এবারের সিজনে অনেক প্লেয়ার চোট পেলেও তারা ফিরে এসেছেন সময়ের আগে; এবারে অন্যান্য দলের তুলনায় চোটের সংখ্যাও বেশ কম মোলিনার মোহনবাগানে! কিংশুক বাবুর মুন্সীয়ানা যে তাতে যারপরনাই সাহায্য করেছে, তা অনস্বীকার্য!
সুভাষ মান্না এবং সিরাজ বাচ্চু:
একটা লম্বা ম্যাচের পর প্লেয়ারদের দরকার পরে একটা রিকভারি সেশনের; যেখানে প্লেয়ারেরা আবার ৯০' এর ক্লান্তি কাটিয়ে আরো একটা লড়াইয়ের জন্য পুরোদমে তৈরি হয়ে উঠবেন! এখানেই অগ্রনী ভূমিকা নেন বাগানের 'Sports Masseur' সিরাজ বাচ্চু এবং সুভাষ মান্না। পরপর ম্যাচ খেলেও প্লেয়াররা তৈরি থাকছেন আরো একটি ম্যাচের জন্যে; তারা তৈরি তাঁদের ১০০% দিতে; সিরাজ, সুভাষ বাবুরা না থাকলে শিল্ড জয় কি এতোটাও সোজা হতো?
অন্বিত ব্যানার্জি:
ফুটবল একটা বিজ্ঞান, যবে থেকে এই মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়েছে বিশ্ব ফুটবল, তবে থেকেই ফুটবলে 'অ্যানালিস্ট' দের গুরুত্ব বেরেছে। এটিকের যুব দলের হয়ে কেরিয়ার শুরুর পর আইএসএলে ইষ্টবেঙ্গল, স্টার স্পোর্টস এবং এআইএফএফ-এর হয়ে কাজ করার পরে অন্বিত যোগ দিয়েছিলেন মোহনবাগানে। তাঁর সাফল্য'ও বেশ ঈর্ষণীয়! হুয়ানের আমলে ২০২৩-২৪ সিজনে বাগানে আসেন অন্বিত। এসেই ডুরান্ড জয়, প্রায় ২০ বছরের ক্ষরা কাটিয়ে যখন বাগানে আসছে ডুরান্ড, তখন সেই সাফল্যে লেখা রয়েছে অন্বিতের নাম; এরপর লীগ শিল্ড, আইএসএল রানার্স, ডুরান্ড রানার্স এবং আরো একটি লীগ শিল্ড! মাঠে যতটা ঠান্ডা মাথায় গোল করেন ম্যাকলারেন'রা, মাঠের বাইরেও ঠিক ততটাই ঠান্ডা মাথায় সেই ফুটেজ অ্যানালাইসিস করে হোসে মোলিনার কাজটা আরও সহজ করে দিচ্ছেন অন্বিত ব্যানার্জি!
অভিষেক ভট্টাচার্য:
ভারতসেরা দল তখনই ভারত সেরা হয়ে ওঠে, যখন একটা ম্যানেজমেন্ট সেই দলের ছোটো থেকে বড়ো সব চাহিদার খেয়াল রাখে! মোহনবাগান ম্যানেজমেন্ট কে এই মুহূর্তে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ম্যানেজমেন্ট বললেও অত্যুক্তি হবেনা। এহেন মোহনবাগান ফুটবল দলের ম্যানেজার কে এধরনের সফল দল কে 'ম্যানেজ' করার জন্য অজস্র বাহবা দেওয়া উচিত। নিঃশব্দে সেই কাজটাই বারবার করে যাচ্ছেন বাগানের অভিষেক ভট্টাচার্য! কোথায় কি খামতি হচ্ছে, প্লেয়ারদের কি চাহিদা, সবকিছুর খেয়াল রাখতে হয় অভিষেক বাবু'কে। তাঁর ব্যক্তিগত মুন্সীয়ানায় মোহনবাগান ড্রেসিংরুম এখন ভারত সেরা! তাই, দলের টীম ম্যানেজার অভিষেক ভট্টাচার্য কে Team MBFTর কুর্নিশ!
বাপ্পা'দা (অনির্বান বিশ্বাস) ও রাজা'দা (রাজা ঘোষ):
প্লেয়ারদের 'কিট ম্যানেজমেন্ট' অধুনা ফুটবলে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অ্যামাজন প্রাইমের 'অল অর নাথিং: ম্যান সিটি' সিরিজ হোক, বা অ্যাপেল টিভির টেড লাসো সিরিজের নাথান শেলী হোক; যেকোনো চ্যাম্পিয়ন দলকে তরতাজা রাখতে সেই দলের কিট ম্যানেজার যে কতটা ভূমিকা রাখেন তা খালি চোখে বোঝা অসম্ভব! এখানেই কৃতিত্ব বাপ্পা'দা, রাজা'দা'র; নিঃশব্দে নিজের কাজটি রোজ করে যাচ্ছেন এঁরা! পর্দার পিছনের এই নায়কদের MBFT র কুর্নিশ!
সমীর ঘোষ:
বেশ কিছুদিন আগে আইএসএলের সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ভিডিও ভাইরাল হয়, মোহনবাগানের বাস চালকের সাথে হাত মিলিয়ে বাস থেকে নামছেন প্লেয়ারেরা। এর কিছুদিন পরেই বাংলার এক বিখ্যাত দৈনিক 'আজকাল' পত্রিকায় সাংবাদিক রাজর্ষি গাঙ্গুলি এক পর্দার পিছনের নায়কের গল্প তুলে ধরেন সবার সামনে। মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনের রথের সারথী ছিলেন স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণ! মোহনবাগানের মতো চ্যাম্পিয়ন দলের রথের সারথী, আজন্ম মোহনবাগানী, বিরাটির সমীর ঘোষ। অভিনন্দন চ্যাটার্জি'র মতোই বাগানের আরেক লাকি চার্ম বলা যেতেই পারে সমীর বাবু কে! ২০১৪-১৫ আই লীগ জয়ী মোহনবাগান দলের বাসের সারথী ছিলেন সমীর বাবু। ২০২৩-২৪ থেকে তিনি নিয়মিত আছেন মোহনবাগানে, জিতেছেন ডুরান্ড এবং দুটি লীগ শিল্ড। মোহনবাগান প্লেয়ারদের সময়ে মাঠে পোঁছে দেওয়া, কখনো বা পাশের রাজ্য জামশেদপুর অবধি দলকে নিয়ে যাওয়া এবং ফেরা, সমীর বাবু তার নিজ ক্ষেত্রে One of the best এবং তাঁর এই স্পিরিট'ই যেনো ছড়িয়ে গেছে মোহনবাগান দলে!
রতন চক্রবর্তী:
দলের যেকোনো আপডেট সবার সামনে আনতে এবং মিডিয়া কে ম্যানেজ করতে যেকোনো সফল দলের দরকার পরে একজন সফল মিডিয়া ম্যানেজারের! সেই কাজটাই মোহনবাগানে বেশ দক্ষতার সাথে করছেন রতন চক্রবর্তী। যেকোনো প্রেস কনফারেন্সে মিডিয়ার চোখা প্রশ্নবান হোক বা কোচ মোলিনা কে প্রেস কনফারেন্সে সহায়তা করা হোক, রতন চক্রবর্তী তার কাজটা সামলাচ্ছেন ভালোভাবেই। তাই, প্রত্যক্ষ ভাবে চ্যাম্পিয়ন দলে কোনো ভূমিকা না রাখলেও পরোক্ষভাবে ভারতসেরা মোহনবাগান দলের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ মোহনবাগানের মিডিয়া ম্যানেজার রতন চক্রবর্তী!
সুষ্ঠভাবে ক্লাব পরিচালনায়, চ্যাম্পিয়ন ম্যানেজমেন্টের সদস্য, দুই বঙ্গতনয় -এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, মিডিয়া ম্যানেজমেন্টে সোশ্যাল মিডিয়া টীমের ভূমিকাও অপরিসীম, এবং, সেখানে নিজেদের কাজের ছাপ রেখে যাচ্ছেন দুই বঙ্গ সন্তান! ভারত সেরা মোহনবাগান কে ভারত সেরা করতে এঁরা ছাড়াও নিজেদের কাজ করে গেছেন অনেক বঙ্গতনয়; তাদের সবাইকে মোহনবাগান জনতার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানায় টীম MBFT!