লিগ্যাসি শব্দের অর্থ কী?
"লিগ্যাসি" শব্দের অর্থ হল উত্তরাধিকার! একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক..
৩রা সেপ্টেম্বর, ২০২৩: বিকেলের যুবভারতী; দিন ১৫-২০ আগে ডুরান্ড গ্রুপ পর্বে ডার্বি হেরেছে মোহনবাগান। ইষ্টবেঙ্গল সমর্থকদের নোংরা বিদ্রুপের লক্ষ্য মোহনবাগান টীম বাস, অত্যুৎসাহী ইষ্টবেঙ্গল সমর্থক অর্ধনগ্ন অবস্থায় নেমে গেছেন মাঠে! ৩ তারিখ ফাইনাল, বদলার ডার্বি। ৬২' এর মাথায় লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যাচ্ছেন অনিরুদ্ধ থাপা, চিন্তার ভাঁজ মোহনবাগান সমর্থক দের কপালে। ৭০ মিনিট, কাউন্টার অ্যাটাকে উঠেছে ইষ্টবেঙ্গল; নন্দাকুমার শেখর এর পাস থেকে ক্লেইটন সিলভার জোড়ালো শট; বাঁচিয়ে দিলেন বাজপাখি বিশাল কাইথ। কাউন্টার অ্যাটাকে উঠছে মোহনবাগান, ১০ জনের মোহনবাগান; মাঝমাঠ থেকে বল পায়ে দুলকি চালে আসতে আসতে উঠছেন বাগানের ৯ নম্বর। চারদিকটা স্ক্যান করছেন, বিপক্ষ ভাবছে এই পাস দেবেন বোধহয়! এভাবেই আসতে আসতে বক্সের বাইরে পৌঁছে গেলেন তিনি, মুহূর্তের অপেক্ষা, তারপর একটা নিখুঁত প্লেসমেন্টে বক্সের বাইরে থেকে শট; মাটিতে নিজের শরীর টা যখন ছুঁড়ে দিচ্ছেন বিপক্ষ গোলকিপার, তিনি তখন অসহায় দর্শক; তার পাশ থেকে বলটা তখন গোলপোস্টের জালটায় জড়িয়ে যাচ্ছে। একটা থমকে যাওয়া মোহনবাগান গ্যালারি, একটা বিশ্বাস হারানো মোহনবাগান গ্যালারি নতুন অক্সিজেন পাচ্ছে! নাম্বার ৯ গায়ে চাপানো লোকটা দৌড়চ্ছেন, তার প্রবল আকাঙ্খা গ্যালারির সাথে মিশে যাওয়ার, সরাসরি না পারলেও লোকটার অস্তিত্ব তখন পুরো মোহনবাগান গ্যালারিতে ছড়িয়ে গেছে!
পুরো গ্যালারি তখন মন্ত্রমুগ্ধের মত একটাই শব্দ উচ্চারণ করছে "দিমি, দিমি"
ফেব্রুয়ারি, ২০২৪: শিল্ড জেতার লড়াইয়ে ভালোভাবে ফিরে এসেছে মোহনবাগান। বিকেলে কোচ হাবাসের কাছে প্র্যাকটিস করে যুবভারতী থেকে বেরিয়ে ফিরছেন পেত্রাতোস। সামনের একটা মাঠে কয়েকটা কচিকাঁচা ফুটবল খেলছে নিজেদের মধ্যে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ খেলা এক যুবক ততদিনে মোহনবাগান জনতার প্রাণের "দিমিগড" হয়েই গেছেন। তিনি বাচ্চাদের অবাক করেই তাদের সাথে সেই মাঠে নেমে গেলেন ফুটবল খেলতে! নাক উঁচু ইষ্টবেঙ্গল সমর্থক রা এমনিতেই দিমিকে পছন্দ করেন না, প্রত্যেক ডার্বি তে গোল করলে পছন্দ না করাই স্বাভাবিক! তবে সেদিন যেনো একটা মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছিলেন কিছুজন! একজন বিশ্বকাপার বিদেশী কাদাপাড়ার কয়েকটা কচিকাঁচার সাথে ফুটবল খেলছে? তারা দিমির নাম দিয়ে দিলেন "বস্তি কা হস্তি".. ওপরওয়ালা সবকিছুর হিসেব জমিয়ে রাখেন; এর কয়েকদিন পর এলো ফিরতি আইএসএল ডার্বি। একটা দিমি পেত্রাতোস সেদিন ধ্বংস করে দিয়েছিলেন ইষ্টবেঙ্গল কে। ম্যাচের ফল ৩-১; ৫-১ হলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিলোনা! দিমিত্রি পেত্রাতোস, একটা গোল ২টি অ্যাসিস্ট। সিজন শেষে আইএসএল চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান, ১০ টা গোল, ৬টা অ্যাসিস্ট করে গোল্ডেন বল জিতলেন পেত্রাতোস। তবে, এর চেয়েও বড়ো পাওয়া? ফেব্রুয়ারির বিকেলে যে মাঠে বাচ্চাদের সাথে খেলতে নেমেছিলেন দিমি, আজ সেই মাঠের নাম "দিমির মাঠ".. অস্ট্রেলিয়ার সিডনির একজন যুবকের নামে একটা পাড়ার মাঠ, এর থেকে বড়ো ভালোবাসার প্রমাণ আর কি হতে পারে?
২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫: মসৃণ শিল্ড যাত্রায় শেষ ল্যাপে হোসে মোলিনার মোহনবাগান! তিন ম্যাচ বাকি, দরকার মাত্র তিন পয়েন্ট। কিন্তু, তিন ম্যাচেই সামনে তিন যুযুধান প্রতিপক্ষ; ওড়িশা, মুম্বাই, গোয়া! আইএসএল ইতিহাসে মোহনবাগানের তিন সবচেয়ে বড়ো গাঁট। ওড়িশা ম্যাচ জিতেই শিল্ড নিশ্চিত করতে চাইছে মোহনবাগান। অপরদিকে, তৈরি সের্জিও লোবেরা'ও। মোহনবাগান কে কিছুতেই পার্টি করতে দেওয়া যাবে না আজ।
ম্যাচটার শুরুটাও হলো সেভাবেই, শুরু থেকেই বেশ নার্ভাস মোহনবাগান; বরং সুযোগ বুঝে বেশ কয়েকবার আক্রমণে উঠছিলো ওড়িশা। ম্যাচের ৭৫' অতিক্রান্ত, হট ফর্মে থাকা জেসন কামিংস কে আনার জন্য গ্যালারি থেকে চ্যান্ট উঠছে; ঠিক তখনই একটা কিস্তির চাল হোসে মোলিনার। সবাইকে অবাক করে মোলিনা মাঠে আনলেন দিমিত্রি পেত্রাতোস কে। দিমি পেত্রাতোস, বাগান জনতার মনের রাজা, মাঠের নতুন রাজা! কিন্তু, এই সিজনে দিমি? গত দুবছরে একটা আইএসএল কাপ, একটা শিল্ড, একটা ডুরান্ড জেতানো লোকটা এবছর হঠাৎ করেই হয়ে গেছেন বাগান জনতার কাছে সবচেয়ে বড়ো টার্গেট। যে দিমি আগের বছর অবধি গোলার মতো শটে বিপক্ষের জাল ছিঁড়ে দিতেন, সেই দিমির এই বছরটা খুবই নিষ্প্রভ গেছে; পুরো মরশুমে ওপেন প্লে থেকে গোল নেই! তবে, সাধারণ মানুষের ভাবনা চিন্তার বাইরেও একটা জগত থাকে, ফুটবল দেবতার নিজের জগত; যেখানে মতি নন্দীর স্টপার গল্পের কমল গুহ থেকে বাস্তবের মোহন জনতার আদরের দিমি, সবার জন্যই তার একটা মুহূর্ত তৈরি করা থাকে, সব হারানোর পর, সব কিছু ফিরে পাওয়ার মুহূর্ত! ম্যাচের বাঁশি তখন ৯২ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে, সময়টা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো সেদিন যুবভারতীতে! অমরিন্দর সিং-এর গোল লক্ষ্য করে শট নিয়েছেন দিমি পেত্রাতোস, মুহূর্তের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বলটা গোলে জড়িয়ে যাচ্ছে! রবিবার রাত্রি ৯.৩০ টায় একটা ফিনিক্স পাখির পুনর্জন্ম দেখছে গোটা ৬০,০০০ লোক, টিভি, ওয়েবের পর্দায় সংখ্যাটা বোধহয় কয়েক কোটি। মাঠ থেকে বুকের মোহনবাগান ব্যাজ চাপড়ে দৌড়ে গ্যালারির ফেন্সিং টপকে সমর্থক দের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন সিডনির একজন। গ্যালারিতে তখন পাগলের মতো চিৎকার করছে কয়েকজন, যারা শেষ একটা বছর লড়াই করেছে প্রিয় দিমিগডের জন্য; নিজের সাথে সাথে তাদেরকেও সেদিন জিতিয়ে দিয়েছিলেন দিমি পেত্রাতোস! বারবার দেওয়ালে পিঠ ঠেকলেও যারা হারেন না, তাদের ই শেষ দিন জিতিয়ে দেন ভগবান, সেদিন দিনটাই দিমির ছিলো; একটা ক্লোজড হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আর ফেসবুক গ্রুপে দিনরাত দিমিকে নিয়ে অ্যাজেন্ডা করা লোকগুলোও কয়েকটা মুহূর্তের জন্য গলা ফুলিয়ে বলতে বাধ্য হয়েছিলো "থ্যাঙ্ক ইউ পেত্রাতোস"
৮ই আগস্ট, ২০২৫: রাত ১২:৪৫ এর দমদম বিমানবন্দর। কাতারে কাতারে ভিড় জমিয়েছে ৮ থেকে ৮০; সবুজ মেরুন রঙে ভরে গেছে এয়ারপোর্টের বাইরেটা; শিলাজিৎ এর 'ডান্ডা টুডুং টুডুং' বাজাচ্ছেন বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া ব্লুটুথ স্পিকারে কিছু সমর্থক; সবার একটাই অপেক্ষা, কখন তিনি বেরোবেন বাইরে? যখন দরজা টা খুলে দিমি বেরিয়ে আসছেন আবেগের বিস্ফোরণ ঘটছে পুরো বিমানবন্দরে; এ জিনিস শেষ দেখা গেছিলো ৭ বছর আগে; চোট কাটিয়ে উইন্টার ট্রান্সফার উইন্ডো তে মোহনবাগানে আবার সই করে ফিরছিলেন সনি নর্দে, প্রায় একটা সিজন অপেক্ষার পর! কিন্তু দিমি তো মোহনবাগান ছাড়েন নি, বিগত তিন সিজিন কাটিয়ে নিজের চতুর্থ সিজনের জন্য আসছেন কলকাতায়! তাহলে? সবার মুখে একটাই কথা; এটাই বোধহয় শেষ বছর বাগানে দিমির! অনিশ্চয়তায় ভরা ফুটবল দুনিয়ায় ২০২৬এ কন্ট্রাক্ট শেষ হলে কি নতুন চুক্তি হবে দিমির সাথে? সত্যিই তো, কেউ জানেনা! তাই প্রিয় দিমি গড কে শেষবারের মতো বরণ করতে যাওয়ার সুযোগ টা কেউই হাতছাড়া করেন নি। দিমি যখন ভিড়ের মাঝে বেরিয়ে আসছেন, ভালোবেসে জনৈক সমর্থক তাকে কাঁধে তুলে নিচ্ছেন! ঠিক যেমনটা বলিউড সিনেমায় কোনো যুদ্ধজয়ের পর রাজাকে কাঁধে তুলে নেন তার সেনাপতি রা! কারণ, দিমিত্রি পেত্রাতোস আর এখন একজন অস্ট্রেলিয়ার ফুটবলার নেই, তিনি এখন বাগান জনতার কাছে "মাঠের রাজা"..
সেই দিমি, যিনি অনায়াসে মিশে যান কাদাপাড়ার কচি কাঁচা দের সাথে, সেই দিমি, যিনি মোহনবাগান জনতার হৃদয়সম্রাট সোনি নর্দে কে ট্রিবিউট দিয়ে করেন স্টেনগান সেলিব্রেশন , সেইদিমি, যিনি নিজের খারাপ দিনেও আত্মবিশ্বাস রাখেন ফিরে আসার, সেই দিমি, যিনি যেকোনো ডার্বি ম্যাচে একজন বাঙালির মতো নিজের সবটা উজাড় করে দেন, সেই দিমি, যিনি অনায়াসে বলতে পারেন, ব্ল্যাঙ্ক চেকের অফার এলেও তিনি মোহনবাগানেই থেকে যাবেন; সেই দিমি, যিনি সিজন শুরুতেই বলতে পারেন, 'কামব্যাক? কামব্যাক ফর হোয়াট?'
সেই দিমি ছাড়া উত্তরাধিকারের সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ আর কিই বা হতে পারে!