আচ্ছা, নেলসন ম্যান্ডেলা যদি কোনোদিন বুটজোড়া পায়ে ফুটবল খেলতেন, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হতো?
এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর হয়তো কারুর কাছেই নেই, তবে, ভারতীয় ফুটবল দলের প্রবাদপ্রতিম কোচ আক্রামভ'কে এই প্রশ্ন করা হলে, হয়তো আপনি শুনতে পাবেন কলকাতা ময়দানের এক শিল্পীর নাম! বা, বলা যেতে পারে, কলকাতা ময়দানের শেষ বাঙালি শিল্পীর নাম; যাঁকে একডাকে পুরো ময়দান চেনে বাসু'দা নামে; আর, তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা দেখে 'আক্রামভ' তার নাম দিয়েছিলেন বাসুদেব 'ম্যান্ডেলা'!
১৩ই'জুলাই,২০০৪; কলকাতা লীগ: গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নামবে মোহনবাগান; প্রতিপক্ষ মহামেডান এসসি। ম্যাচের আগেই হঠাৎ খবর এলো, প্রয়াত হয়েছেন বাসুদেবের বাবা! ম্যাচের সকালে বাবার শেষকৃত্য করে 'কাছা গায়েই' ম্যাচের আগে যুবভারতীতে হাজির মোহন জনতার 'বাসু দা'। দলের প্রয়োজনে মাঠে নামলেন, ৩-১ গোলে জিতলো মোহনবাগান!ম্যাচ শেষে তার সরল স্বীকারোক্তি "বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা সারা জীবন ভুলতে পারব না। যদি কিছুটা পারি, সেই জন্যই তো ফুটবলের কাছে আসা।"
আচ্ছা জাভি বা পির্লো যদি ভারতে জন্মাতেন, কেমন হতো? এর'ও উত্তর হয়তো বাসুদেব নিজেই!
The Hard Tackle ওয়েবসাইটে বাসুদেব কে বর্ণনা করতে গিয়ে সোমনাথ সেনগুপ্ত লিখেছেন "কৃশানু দে'র উত্তরসূরি বলতে কাউকে যদি বাছতে হয়, তবে একমাত্র বাসুদেব মন্ডল'ই সেই সিংহাসনের দাবীদার হতে পারেন।ছিপছিপে চেহারা এবং মাঝারি গড়নের বাসুদেব-এর খেলার ধরনে জাভি এবং পির্লোর ছাপ পাওয়া যায়। তাদের মতোই বাসুদেব-ও মাপা পাস বারানোয় দক্ষ! 'পিক ফর্মের' বাসুদেবের মতো মাপা থ্রু হাতেগোনা কয়েকজন বাঙালী ফুটবলার'ই বারাতে পারেন"!
কেরিয়ারের শুরু হয়েছিলো জামশেদপুর-এর টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমি থেকে। তারপর ১৯৯৫-এ কলকাতা ময়দানে তাঁর আগমন। সই করলেন 'উয়াড়ি' তে; সেই 'উয়াড়ি', যেখান থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে হালের প্রীতম কোটাল, কিংশুক দের; বা একসময়ের তুষার রক্ষিত, দীলিপ পালিত দের। উয়াড়িতে তার নজরকাড়া পারফর্মেন্স চোখ টানে বড়ো ক্লাবদের। ১৯৯৪-এই ইষ্টবেঙ্গল ছেড়েছেন "ভারতের মারাদোনা" কৃশানু দে। নতুন মিডফিল্ডার-এর খোঁজে মত্ত লাল হলুদ শিবির। কৃশানুর উত্তরসূরি হিসেবেই তারা সই করান উঠতি প্রতিভা বাসুদেব কে। লালু হলুদ জার্সি গায়ে প্রথম বছর কলকাতা লীগ জেতালেন বাসু'দা।
পরের বছর সেরা দল গড়তে মরিয়া মোহনবাগান; লক্ষ্য একটাই; জাতীয় লীগ জয়। সেই যে মোহনবাগানে সই বাসুদেবের, তার পর আছে পিছনে ফিরে তাকান নি। প্রায় ১০ বছর খেলেছেন সবুজ মেরুন জার্সিতে। এই সময়টাকেই বাসুদেব মন্ডল নিজের শ্রেষ্ঠ খেলাটা খেলছে বলা যেতে পারে। ১৯৯৭-২০০৬, তিনটে ন্যাশনাল লিগ পাওয়া মোহন বাগানের সোনালী সময়ে বাসুদেব কাটিয়েছেন মোহনবাগানে l অজস্র খেতাব জেতার পিছনে নিজের অনিবার্য অবদান রেখে গেছেন।
মোহনবাগান সমর্থক সুমন্ত ব্যানার্জী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন "অমল দত্তের 'ডায়মন্ড সিস্টেম'এর প্রধান হিরে টা ছিলো বাসুদেব মন্ডল; ১৯৯৭ এর ফেড কাপ কোয়ার্টার ফাইনালে চার্চিল ব্রাদার্স কে ৬ গোল মারে মোহনবাগান। ম্যান্ডেলার গোলে খাতা খোলে বাগান তারপর একে একে ওকোরি এবং খালিককে সাজিয়ে দেন ৫টি অ্যাসিস্ট!"
পুরো সংখ্যা দেখতে গেলে, মোহনবাগানে বাসুদা জিতেছেন ২০ টি খেতাব ( NFL 3, CFL 4, IFA Shield 2, Durand 1 ,DCM 1, Rovers 1,Airlines Gold Cup 5, Bordolui 1, Sikkim Gold Cup 2)। তবে, মোহনবাগানে বাসুদেবের impact বোধহয় শুধু ট্রফি দিয়ে মাপতে চাওয়া ভুল হবে।
আরেক মোহনবাগান সমর্থক শিলক চ্যাটার্জী বলছেন "বাসুদেব বোধহয় ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে underrated ফুটবলার; অমল দত্তের দলে নিউক্লিয়াস ছিলেন বাসুদেব; অসাধারন থ্রু পাস এবং দূরপাল্লার শট ছিলো তার ইউএসপি!" তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে গ্যালারি থেকে মিডিয়া, সমর্থক থেকে প্রতিপক্ষ কোচ সবাই একমত ছিলেন, "বাসুদেব খেলতে খেলতে পুরো মাঠ দেখতে পায়"
প্রাক্তন ভারতীয় কোচ রুস্তম আক্রমভ বলেছিলেন, বাসুদেবের বিদেশে খেলার ক্ষমতা আছে। এ থেকেই ধারনা করা যায় তার দক্ষতার সম্পর্কে! কিছুদিন আগে জনি কাউকোকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বাসুদা লিখেছিলেন "থ্রু বল বাড়ানোটা একজন ফুটবলারের বিশেষ দক্ষতা। হাজার অনুশীলনেও তা শেখানো যায় না। নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিপক্ষে জনি কাউকোর ৩০ গজের থ্রু পাস উস্কে দিল শিল্পী ফুটবলারের স্মৃতি। এমন দৃষ্টিনন্দন ফুটবল দেখার জন্যই তো মাঠ ভরান হাজার হাজার সমর্থক।" অজান্তেই কখনো বোধহয় নিজের ফুটবল শৈলীর বর্ণনা করে ফেলেছিলেন এখানে বাসুদেব দা। যতদিন পায় বল ছিল, গোলের ঠিকানা লেখা সুচীভেদ্য অভ্রান্ত পাস বাড়িয়ে গেছে খর্বকায় শ্যামবর্ণ বাগানের ১৪ নাম্বার মিডিয়ো। দূরপাল্লার শট একজন মাঝমাঠের খেলোয়াড়ের বড়ো অস্ত্র; আর, বাগানের মাঝমাঠ জেনারেলের আস্তিনে ছিলো সেই তাস। মোহনবাগান কে কতো ম্যাচে দূরপাল্লার শটে বিশ্বমানের গোলে পয়েন্ট এনে দিয়েছেন ১৪ নাম্বার জার্সিধারী, তার ইয়ত্তা নেই।
শুধু জাতীয় ক্লাবের জার্সিতেই না, জাতীয় দলের হয়েও নিজের দক্ষতার ছাপ রেখেছেন বাসুদেব। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত মিলেনিয়াম সুপার কাপে ভারতের অধিনায়ক নির্বাচিত হন মোহনবাগানের 'মিডফিল্ড জেনারেল'! সেসময়ে উরুগুয়ে এবং আইসল্যান্ডের বিপক্ষে জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করার অনন্য সম্মান পেয়েছেন বাসু'দা। ভারতের জার্সি গায়ে খেলেছেন ইংলিশ লীগের লেজেন্ডারি ক্লাব ফুলহ্যামের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচেও! জাতীয় দলের জার্সিতে ২০ টি ম্যাচে ১ টি গোল আছে বাসুদেবের।
মোহনবাগানে শেষ মরসুম অবধি নিজের জাত চিনিয়ে গেছেন বাসুদেব; ফেডকাপ জিতে বিদায় নিয়েছেন রাজার মতো। তারপর কেরিয়ারের সায়াহ্নে এসে ২ বছর মহামেডান, ৩ বছর ইউনাইটেড এসসি'তে খেলে চিরবিদায় জানিয়েছেন ফুটবল কে!
মারাদোনা থেকে কৃশানু দে, ফুটবলের জাদুকরেরা বাস্তবের দুনিয়াতেও মাটির মানুষ। দেশের, দশের ভালোর জন্য তারা সবসময় হাজির! বাসুদেব মন্ডল'ই বা ব্যাতিক্রম হন কি করে! কোভিডের মধ্যেই যখন ভয়াবহ আম্ফান ঝড় ধেয়ে এলো, তখন নিজের সতীর্থদের সাথেই সবার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন বাসুদেব দা। কোভিডে দুঃস্থদের সাহায্যেও বাসুদেব দা পিছপা হননি! আজ'ও ময়দানে কোনো প্রাক্তন ফুটবলারের জন্য প্রদর্শনী ম্যাচ হলে, একটা নাম টীম লিস্টে থাকবেই: বাসুদেব মন্ডল!
শেয়ার মার্কেট, রিয়াল এস্টেট, মিউচুয়াল ফান্ডের যুগে ময়দানের বাসুদেব মন্ডল ইন্ডিয়া টুডে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "I belong to old school and belive in bank deposits. I have taken a lot of Lic Policies."
মাঠে থাকার দিনগুলো মতন "নন ফ্ল্যামবয়ানট" এবং "ট্র্যাডিশনাল" থেকে গেছেন সদ্য ৫০ পেরোনো বাসুদেব মন্ডল।
ফুটবল খেলেন অনেকেই, ফ্যানেদের কাছে প্রিয়-ও হন কিছুজন। Legend হিসেবে অবসর নেন কয়েকজন'ই! কিন্তু, ICON?
ICON বোধহয় তারাই হন, যারা মাঠ এবং মাঠের বাইরেও জীবন বদলে দেন মানুষের, আর পাঁচটা LEGEND এর থেকে ICON কে আলাদা করে দেয় সাধারণ মানুষের কাছে তার অর্জন করা অমরত্ব!
মাঠে একজন প্রকৃত নেতা, একজন দক্ষ সৈনিক, সাংবাদিক দেবাশীষ সেনগুপ্তের ভাষায় 'ময়দানের শেষ শৈল্পিক টার্মিনাস', সুখবিন্দর সিং-এর বাসুদেব 'ম্যান্ডেলা' তাই ইষ্টবেঙ্গল, মহামেডান খেললেও মোহনবাগান জনতার 'ঘরের ছেলে'; কলকাতা ময়দান তথা ভারতীয় ফুটবলের A True Icon!
কলমে প্রবুদ্ধ গুছাইত
Follow MBFT on Twitter, Facebook, Instagram, Youtube, Telegram, Whatsapp & Google News to stay updated with all the Mohun Bagan & Indian Football related News & Updates. Jai Hind Jai Bharat! Joy Mohun Bagan!