৬৭ সালে ইডেনে অনুষ্ঠিত প্রথম বড়ম্যাচে এক গোলে এগিয়ে থেকেও ১-২ এ হারতে হয়েছিল মোহনবাগানকে। এবারের বড়ম্যাচটা শেষবারের মত খেলা হবে ইডেনে। এবার কি জয় পাবে মোহনবাগান?
খেলা শুরু হলো, সমানতালে চলছিল খেলা, তবুও কিছুটা যেন নিস্তরঙ্গ খেলা। মাঝে মোহনবাগান একবার পেনাল্টি পাওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হলেও রেফারির বদান্যতায় পেনাল্টি পাওয়া আর হয়নি। প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূণ্যভাবে।
“উত্তেজনাহীন, একঘেয়ে প্রথমার্ধের ঝুলে যাওয়া খেলা দেখে যখন একটি নিশ্চিত ড্রয়ের চিন্তা জাগছিল, ঠিক তখনই ম্যাচের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি ঘটে গেল। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা তখন সাত মিনিট। ইস্টবেঙ্গল পেনাল্টি বক্সের বাইরে থেকে প্রশান্তর বাঁ পায়ের ‘ডায়াগোনাল স্পিন’ মেশানো আপাত-নিরীহ ফ্রিকিকটি দুই স্টপারের মধ্যে ঝুলে রইলো , অল্পসময়। সেই সামান্য ফাঁকে কৃষ্ণগোপাল ছুটে এসে মাথা ছুঁইয়ে বলের গায়ে বাবু মানির ঠিকানা লিখে দিলেন। ডিপ-ডিফেন্সের দুটি সব চেয়ে মজবুত মিনার মনোরঞ্জন- তরুণকে পায়ের ছোট টাচে টলিয়ে দিয়ে বাবু মানি ঠাণ্ডা মাথায় বল ঠেলে দিলেন জালে। ‘গো ও ল’ শব্দে গর্জে উঠল ইডেন। মাত্র কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল সব কিছু। বিস্মিত ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা শুধু দেখলেন, ডিফেন্ডাররা নির্বাক, হতভম্ব। অসহায়ভাবে মাটিতে পড়ে আছেন শেষ প্রহরী ভাস্কর। এবং ঊনিশ নম্বর জার্সি পরা এক কানাড়ি যুবক তাঁদের সব সম্মান স্বপ্ন লুঠ করে, দুহাত আকাশে ছড়িয়ে মিশে গেলো মোহনবাগানীদের আলিঙ্গনে, উল্লাসে।
গোল। মোহনবাগান ডিফেন্সে অটল স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইলেন সুব্রত ভট্টাচার্য। কপালে সেলাই নিয়েও অসাধারণ খেললেন তিনি।"
এইভাবেই গোলের বর্ণনা লেখা হয়েছিল পাক্ষিক আনন্দমেলার পাতায়। সুব্রত ভট্টাচার্য্যের অদম্য জেদকে সঙ্গী করে মোহনবাগানের ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বছর একুশের এক কন্নড় তরুণ, বাবু মানি। খেলা শেষের বাঁশি বাজতেই বিজয়োৎসবে মুখরিত হয়ে উঠল মোহনজনতা। গোলদাতা বাবু মানিকে ইডেন থেকে কাঁধে চড়িয়ে মোহনবাগান তাঁবুতে পৌঁছে দিয়েছিলেন সমর্থকেরা।
Courtesy : Subir Mukherjee / MB E-Library |
ব্যাঙ্গালোরের অশোকনগরে জন্ম মানির। দক্ষিণ ভারতীয় প্রথা অনুযায়ী নামের আগে বসল বাবা এম বাবুর নাম, পরিচিত হলো বাবু মানি নামে। বাবা মায়ের প্রশ্রয়েই ফুটবলে হাতেখড়ি মানির। স্থানীয় ইন্ডিপেন্ডেন্স ক্লাবে কেরিয়ার শুরু করে থার্ড ডিভিশন ক্লাব রিনাইকো হয়ে সুযোগ পেলেন প্রথম ডিভিশনের ক্লাব আই টি আই এর জুনিয়র দলে। সেখানে বিখ্যাত এক প্রাক্তন ফুটবলার রমনের নজরে পড়েন মানি। তাঁর সুপরিশেই সন্তোষের দলে জায়গা হলো বাবু মানির। ত্রিচূরে ন্যাশনালে দারুণ খেলার সুবাদে নজরে পড়লেন ফুটবলবোদ্ধাদের। আন্তঃরাজ্য ছাড়পত্র জমা দিয়ে পাড়ি জমালেন বাংলায়। এখানেই শুরু হলো দক্ষিণ ভারতীয় পরিবারের একটি ছেলের বাংলার ঘরের ছেলে হয়ে ওঠার যাত্রা।
মাত্র আঠারো বছরেই সই মহমেডান স্পোর্টিং-এ। বেশি সুযোগ না পেলেও নজর কেড়েছিলেন স্বল্প সময়েই। পরের বছর কলকাতা লীগে নজরে পড়লেন মোহনবাগান কর্তাদের। উল্গনাথনের সহায়তায় ভিক্টর অমলরাজ আর ফরিদের সঙ্গে তাকেও টার্গেট করল মোহনবাগান। ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে মানির বাবা মায়ের সাথে কথাও বলে এলেন। শোনা যায়, সইয়ের আগে গজু বসুর হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন মানিরা। আবার মহমেডান থেকে আসা খেলোয়াড়দের যাতে কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য নাকি প্র্যাকটিসের সময় নিয়ম করে মাঠে পাহারা দিতেন তৎকালীন মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী। অনেকেই বলেছিলেন তারকাখচিত মোহনবাগানে এসে ভুল করলেন বাবু। সেকথা ভুল করলেন প্রথম ম্যাচেই। ১৯৮৪ই মানির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। মোহনবাগানের হয়ে অভিষেক ম্যাচেই হ্যাটট্রিক, ২৮শে মে ১৯৮৪, কলকাতা লীগে জর্জের বিরুদ্ধে। সেবছরই বড়ম্যাচে গোল করে দলকে জয় উপহার, আবার সেবারেই জাতীয় দলে সুযোগ।
প্রায় দেড় দশক কলকাতার বড় দলগুলোয় খেলেছেন সুনামের সঙ্গে। একসময় ময়দানের পঁয়ষট্টি পয়সার গ্যালারিতে আদর করে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল পাঁকাল। তীব্র গতিতে মাঝমাঠ থেকে বল ধরে দু-চারজনকে কাটিয়ে গোল করার দক্ষতার জন্যই এই নাম। ছড়াও বাঁধা হয়েছিল তাকে নিয়ে, 'বাবু মানির পায়ে বল, ভাস্করের চোখে জল'। উইং দিয়ে দৌড়ে বিপক্ষ ডিফেন্স চিরে ভেতরে ঢোকার সময় ক্রমাগত ট্যাকলের সম্মুখীন হলে সাইডলাইন থেকে কোচ অমল দত্তের চিৎকার, "বাবু বল ছাড়িস না", আজও বহু ফুটবলপ্রেমীর কানে বাজে। মূলত রাইট উইঙ্গার হলেও ফরোয়ার্ডে খেলতে পারতেন। ভারতের হয়ে ৫৫ ম্যাচ খেলে জাত চিনিয়েছিলেন। জিতেছেন সাউথ এশিয়ান গেমসের স্বর্ণপদক ১৯৮৫ এবং ৮৭ তে। বাংলার হয়ে সন্তোষ জয় ৮৬-৮৭ এবং ৮৮-৮৯ মরশুমে। কলকাতার তিন প্রধানের হয়ে ভারতের প্রায় সব ঘরোয়া ট্রফিই জিতেছেন, যদিও সর্বাধিক সাফল্য মোহনবাগানের হয়ে।
তাঁর ফুটবল জীবনের টুকরো টুকরো স্মৃতি সমর্থকদের মনের মণিকোঠায় আজও অমলিন। '৮৬-এর ডুরান্ড ফাইনালে ডানপ্রান্তে কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে অসাধারণ দক্ষতায় একজন ডিফেন্ডারকে টপকে গোললাইন থেকে মাপা সেন্টার শিশিরের মাথায়, শিশির সেই বল নামিয়ে দিল দেবাশীষ রায়কে, দেবাশীষ এক টাচে বল জড়িয়ে দিল জালে। আমার দেখা সেরা মুভমেন্টগুলোর অন্যতম। এই গোলের সুবাদে মোহনবাগান দ্বিতীয়বার ডুরান্ড জয়ের হ্যাটট্রিক করে।' - সমিত চ্যাটার্জি নামক এক মোহনবাগান সমর্থকের স্মৃতিচারণায় ধরা পড়েছেন বাবু মানি।
আরেকটি ঘটনা তো রীতিমত শিহরণ জাগায় শরীরে। এই ১৯৮৬-এরই সিকিম গভর্ণর্স গোল্ড কাপ। মোহনবাগান তখন দারুণ ফর্মে। ম্যাচের পর ম্যাচ হীরকদ্যুতির মত ঝলকে উঠছেন বাবু মানি। প্রথম খেলায় মোহনবাগান জেতে সাত গোলে। সেমিফাইনালে সামনে পড়ল সিকিমের স্থানীয় একটা দল। মোহনবাগান আর বাবু মানির ফর্ম অব্যাহত। গোলের পর গোল হচ্ছে। পরপর তিনগোল হবার পর সাইডলাইনের ধারে বসে থাকা তৎকালীন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী নরবাহাদুর ভান্ডারী বলে উঠলেন, "ওহে মানি, আর গোল দিও না। ওরা ডিমরালাইজ হয়ে যাবে।" কিন্তু কোথায় কি! মোহনবাগান শেষমেশ থামল ছ'গোল করার পর। মানি করলেন তিন গোল, সঙ্গে একটা অ্যাসিস্ট। খেলার পর মানি জানালেন মুখ্যমন্ত্রীর কথা তিনি শুনতে পাননি। বোঝো কাণ্ড!
Courtesy : AIFF Media |
প্রবল গরমের মাঝে কালবৈশাখী এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়েও মানুষকে খানিকটা স্বস্তি দিয়ে যায়, বাবু মানিও সেরকমই এক স্বস্তির নাম। বিপক্ষকে বারবার তছনছ করে দিয়ে নিজের দলকে ম্যাচ জিততে সাহায্য করা ছিল বাবু মানির সহজাত গুণ। খেলোয়াড়ি জীবনে বরাবরই অবিতর্কিত, শান্ত ও ভদ্রতার প্রতিমূর্তি। গোটা বিশ্ব যখন ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত, মাত্র ৫৯ বছর বয়সে দুরারোগ্য লিভারের অসুখে অমৃতলোকের পথে পাড়ি দিলেন বাবু মানি। কিছুটা নীরবে, নিঃশব্দে।
কলমে: সাত্যকি আদিত্য মিত্র