৬ মে ২০১২, রবিবার। ভীষণ ভ্যাপসা এক দুপুরে যুবভারতী খুব থম থমে। আগেরদিন ইডেন দেখেছে এক হাই ভোল্টেজ IPL ম্যাচ। সৌরভ গাঙ্গুলির পুনে ওয়ারিয়র্স বনাম কলকাতা নাইট রাইডার্স। কিন্তু রবিবারসরি যুবভারতী হটাৎ কেনো প্রাণহীন?
রবিবার ৬ মে ২০১২। মোহনবাগান শেষ আই লীগ ম্যাচ পুনে এফসি বিরুদ্ধে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড় থেকে দল ছিটকে গেছে অনেকদিন। অথচ ৬০০০০ ফুটবল প্রেমী সেদিন যুবভারতী ভরিয়েছিল। কারণ, রবিবার বিকেলে বাগানের দীর্ঘদিনের "শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা" শেষবার ভরসা যোগাতে মাঠে নামছেন।
ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে যায় শতাব্দীর শুরুতে। ফুটবল সম্রাট পেলের দেশ থেকে মোহনবাগানে আগমন হলো এক মাঝারি গড়ন ব্রাজিলিয়ান। তখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ফুটবলের এত রমরমা হয়নি। আপামর বাঙালির কাছে আবেগ বলতে ইস্ট এবং মোহন। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০০ মারগাও ডেম্পোর বিরুদ্ধে প্রথম গোল সবুজ মেরুন ১০ নম্বর গায়ে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিনি যে কখন বাগান সমর্থকদের প্রাণভ্রমরা হয়ে উঠেছিলেন, সেটা বোধহয় নিজেও ঠাহর করতে পারেননি। দীর্ঘদেহী ইগোর কে পাশে নিয়ে যখন বাগানের ঘরে দ্বিতীয় NFL তুললেন, তখন বাগানের আকাশে শব্দব্রহ্মের মতো আছড়ে পড়ল, 'শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, ব্যারেটোই ভরসা।'
রবিবার ৬ মে ২০১২। ম্যাচ শুরু হল। নিজের ক্যারিয়ার গোধূলিতে একটি গুরুত্বহীন ম্যাচ, নিজের পরিশ্রম ও বুদ্ধি দিয়ে মোহন জনতার মণিকোঠায় তুলে রাখলেন। ৬ মিনিটের মাথায় প্রথম গোলটা সতীর্থ হাডসন লিমার পাস থেকে। নিখুঁত সার্জিক্যাল প্লেসিং পরাস্থ হতে হল দেশের ১ নম্বর কিপার সুব্রত পাল। তার ফুটবলের সূর্যাস্তে দেখা গেল সূর্যোদয়। ভগবানের অবসর হয়ে নাকি? ওই তো একজনই মোহনবাগানের যীশু।
ডুরান্ড কাপ, সিকিম গভর্নর কাপ এয়ারলাইনস গোল্ড কাপ, ফেডারেশন কাপ একে একে সব এই এসেছে মোহনবাগান তাঁবুতে তর তত্বাবধানে। কিন্তু ২০০৪ দেশের সবচেয়ে আগ্রাসী বিদেশি রিক্রুটকে ক্লাব ছাড়া করালেন একদল কর্মকর্তা। তাতে ক্লাব বা তাদের কি লাভ হয়েছিল, তা আজও বোধগম্য হয়নি। বাগানে ব্যারেটোর হাফ - টাইম বাঁশি বেজে উঠলো। যীশুহিন বাগানে ২ বছর ফুল ফোটেনি।
মোহনবাগানের হয়ে নিজের শেষ ম্যাচে শেষ গোল করছেন ব্যারেটো |
রবিবার ৬ মে ২০১২। ম্যাচের বিরতিতে গলায় মালা পরে একটার পর একটা বল মেরে গ্যালারিতে পাঠাচ্ছেন এবং একটা ছোট হাসি হেসে হাত নাড়ছেন। যখন স্টেডিয়ামের ট্র্যাক ধরে হাঁটছিলেন, গ্যালারিতে অজস্র তরুণ দৌড়ে যাচ্ছে এক দিক থেকে ওপর দিক। ওদের চোখে জল। মুখে জয়ধ্বনি। মোজেস এর বাইবেলের যীশুকে তারা চেনেনা। তাদের যিশু সবুজ মেরুন ১০ নম্বর পরে।
২০০৬ বাগানে সেকেন্ড হাফ শুরু হল। ঘরে ফিরলেন ঘরের ছেলে। পাশে পেলেন পাহাড়ি বিছে, বাইচুং। আবার শুরু হলো মোহনবাগানের বিজয় রথ। ফেডারেশন কাপ, সুপার কাপ একে একে আবার আলোকিত হলো মোহন তাঁবু, ট্রফির জৌলসে। ৫ গোল হজম করার ৩৪ বছরের পুরনো ক্ষত, মিলিয়ে দিলে তোমার জাদুতে।
মোটা টাকায় আসলেন চার্চিলের ত্রাস, ওডাফা। তুমি এক গাল হেসে জুটি বাঁধলেন নাইজেরিয়ান সাথে। ওডাফা প্রথম থেকেই ভেবেছিলেন, শেষ দিনে গোলের যুগলবন্দী উপহার দেবেন। চিত্রনাট্য ছিল তাই। ম্যাচের ১ মিনিট বাকি থাকতে ওডাফার গোলের রাস্তাটা তোমার পাস দিয়েই শুরু। ম্যাচ শেষে উপহার তুলে দেওয়ার সময়ে ওডাফা দেশের সেরা স্ট্রাইকার না, যীশুর আকুল ভক্ত।
রবিবার ৬ মে ২০১২। সন্ধ্যে নামছে যুবভারতীতে। কিছুক্ষন আগে জোসে রামিরেস ব্যারোটো শেষবারের মতন মাঠ ছেড়েছেন "সবুজ তোতা" হয়ে। গ্যালারি তখনো থম থমে। হাজার হাজার শোকাহত ভক্ত দাড়িয়ে। স্লোগান নাই, হাসি নাই, নাচ-গান নাই। কাট আউট লেখাটা তখনো জ্বলজ্বল করছে,
"Without you impossible. Thanks Jesus. Mohun Bagan forever."
কলমে Rishav Roy