মোহনবাগান, শীল্ড জয়ের পরবর্তী দশক , রোভার্স, ডুরান্ড, কলকাতা লীগ, কলকাতা ডার্বির আবির্ভাব ও লোগো বদল। আবহমান মোহনবাগান পর্ব ৪। ১৯১২-২৪

মোহনবাগান, শীল্ড জয়ের পরবর্তী দশক , রোভার্স, ডুরান্ড, কলকাতা লীগ, কলকাতা ডার্বির আবির্ভাব ও লোগো বদল। আবহমান মোহনবাগান পর্ব ৪। ১৯১২-২৪


মোহনবাগানের সেকাল থেকে একাল, পুরোটাকেই নথিবদ্ধ করে রাখতে বদ্ধপরিকর MBFT! তাই, গতদিনের প্রথমদ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ের পর, আজকে, আমাদের “আবহমান মোহনবাগান” সিরিজের চতুর্থ অধ্যায় : শীল্ড জয়ের পরবর্তী দশক , রোভার্স, ডুরান্ড, কলকাতা লীগ, কলকাতা ডার্বির আবির্ভাব ও লোগো বদল।

১. স্পট ফিক্সিং ও বিদায় ক্যাপ্টেন। ১৯১২

ব্রিটিশ দম্ভ চূর্ণ করে মোহনবাগান জিতে নিয়েছে সেরার শিরোপা। ১৯১১-এর শিল্ড জয় সাধারণ মানুষের বুকে যেমন একটা বিপ্লবের আগুনকে জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তেমনই মোহনবাগানের জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে গগনচুম্বি, মোহনবাগান হয়ে উঠেছিল জাতীয় সংগ্রামের একটি অংশ। 

অঙ্কুর কোনার তাঁর "Mohun Bagan Played Back" শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন: "People irrespective of class, caste or community became very much attracted by the dream of defeating the ruling British at their own game. Tinged with unputdownable spirit and allied with the recognition of local culture, the spirit of Mohun Bagan, both as a team (local identity) as well as a representative of a particular nation (national identity) offer and proffer an immortal victory against the immoral domination."

শিল্ড ফাইনালের পর তাৎপর্যপূর্ণভাবে "দ্য ইংলিশম্যান" লিখেছিল, 'কংগ্রেস আর স্বদেশী রা যেটা পারেনি সেটা মোহনবাগান করতে সক্ষম হয়েছে। ব্রিটিশরা যে কোনো ক্ষেত্রে অপরাজেয়—তারা এই মিথ ভাঙতে সক্ষম হয়েছে।' এবং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ব্রিটিশ সরকার এই বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি।

তাদের রাগ, ঈর্ষা ও ঘৃণা অবশেষে আইএফএ শিল্ড ১৯১২ তে "স্পট ফিক্সিং" রূপে নেমে আসে। তারা এবার রেফারির ইংরেজদের পক্ষপাতিত্ব করার বিষয়টিকে নিশ্চিত করেন। "ক্লাবের নাম মোহনবাগান" বইতে শান্তিপ্রিয় বন্দোপাধ্যায় ব্যাখ্যা করেছেন যে কীভাবে মোহনবাগানের দুটি সম্পূর্ণ বৈধ গোল রেফারি অফসাইড ঘোষণা করেছিলেন ক্যালকাটা এফসির বিপক্ষে। 

এই ঘৃণ্য কাজটি মেসার্স জে.এফ. মদন অ্যান্ড কোম্পানির করা ভিডিওর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল। যেখানে স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছিল যে মোহনবাগানের বাতিল হওয়া দুটি গোলের সময়েই অফসাইডের কোনো নিয়মভঙ্গ হয়নি। চক্রান্তের শিকার হয়ে মোহনবাগান ম্যাচটি ১-২ গোলে পরাজিত হয়ে শিল্ড থেকে বেরিয়ে যায়।

এই নক্কারজনক ঘটনা অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়িকে ভীষণভাবে আহত করে। চিরকাল সত্য এবং সততার পূজারী শিবদাস নিজের ফুটবল জীবনের ফর্মের শিখরে থাকাকালীন মোহনবাগানের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন এবং হঠাৎই ক্লাব ছেড়ে চলে যান। মাঠের বাইরে ক্রমশ চলতে থাকা এই অন্যায় দেখতে দেখতে তিনি হয়তো নিজের মধ্যে একটা ক্লান্তি অনুভব করেছিলেন। আজ আমরা যাদেরকে "অমর একাদশ" নামে নামাঙ্কিত করেছি, সেই একাদশের শ্রেষ্ঠতম রত্নটি পেশাদার ফুটবল ছেড়ে দিয়েছিলেন নিঃশব্দে, অকস্মাৎ। 

শিবদাসের পরে ১১-এর শিল্ডজয়ী দলের আরেক সদস্য হাবুল সরকার মোহনবাগানের অধিনায়ক নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী তিন বছর তিনিই মোহনবাগানের অধিনায়কত্ব করেন।


২. “সারা জীবন‌ই বল খেইল্যা গেল ”। ১৯১২-১৩



মোহনবাগানের শিল্ড জয়ী দলের দুই সদস্য রাজেন সেনগুপ্ত এবং অভিলাষ ঘোষ পূর্ববঙ্গের ভাগ্যকূলে মুকুন্দলাল রায় মেমোরিয়াল শিল্ডে খেলতে গিয়ে বিপক্ষের রক্ষণে একটি কিশোরের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান।

রাজেন জানতে পেরেছিলেন যে এই ১৬ বছরের ছেলেটি কলকাতায় থাকে এবং ছুটির দিনে তার পৈতৃক বাড়িতে বেড়াতে যায়। রাজেন ছেলেটিকে মোহনবাগানে ট্রায়ালের জন্য প্রস্তাব দেন এবং কলকাতায় পৌঁছে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। ছেলেটি জানায় যে সেও হাজার হাজার মানুষের মতো ১৯১১-এর শিল্ড ফাইনাল দেখতে মাঠে উপস্থিত ছিল তার মামার সঙ্গে। ছেলেটির নাম গোষ্ঠ পাল।

গোষ্ঠ পাল তাঁর প্রথম ফুটবল পান তাঁর জ্যাঠতুতো ভাই মতিলাল এর কাছ থেকে। শুধু ফুটবল পেয়েই ক্ষান্ত হননি দুই ভাই, সমবয়সী বন্ধুদের জুটিয়ে একটা আস্ত ফুটবল দল তৈরি করে ফেলেন - দ্য ক্যালকাটা ইউনিয়ন ক্লাব, এবং কুমোরটুলি ক্লাবের মাঠে প্র্যাকটিস করার সুযোগও পায়। সেখান থেকে কুমোরটুলি ক্লাবের ছোটদের দল - ‘কুমোরটুলি জুভেনাইল ক্লাব’এ খেলার সুযোগ পায় ।

নবাগত গোষ্ঠ পাল সবার নজর কাড়লেও মোহনবাগানের মতো বড়ো ক্লাবে খেলার উপযুক্ত কিনা সেই নিয়ে দ্বিধা ছিল ক্লাবের অন্দরে। মোহনবাগান আহসানুল্লাহ কাপে, ডালহৌসির বিরুদ্ধে ম্যাচে ট্রায়াল দিয়ে গোষ্ঠ পাল-কে পরখ করে দেখে নিতে চায়। তাঁর পছন্দের পজিশন, রাইট হাফ-এ শুরু করলেও, জার্সি সঙ্গে না থাকায় পরনে সুতির জামা আর ধুতি পরেই খেলতে নামেন। 

প্রথম ম্যাচ ও ধুতি পরে খেলার অনভিজ্ঞতার কারণে অনেক ভুল করে বসে। গোষ্ঠ পালের সবুজ-মেরুন জার্সি পরাই হত না, যদি না ভুতি সুকুলকে পাশে পেতেন। বাগান কর্মকর্তারা যখন প্রায় ঠিকই করে নিয়েছে, গোষ্ঠ পাল-কে নেওয়া হবে না, ভুতি সুকুল তখন তরুণ গোষ্ঠ-কে লেফ্ট ব্যাকে দেখে নিতে অনুরোধ করেন। আগেরবারের কলকাতা লীগ চ্যাম্পিয়ন দল, ‘ব্ল্যাক ওয়াচ’ এর বিরুদ্ধে সেই পরীক্ষায় স্বমহিমায় উত্তীর্ণ হন গোষ্ঠ পাল।

মোহনবাগান জার্সি চাপিয়ে দীর্ঘ ২৩ বছরের বছরের সফরের সেই শুরু। তারপরেও দীর্ঘদিন মোহনবাগান ও ময়দানে বিভিন্ন পদে যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর এদেশেই থেকে যান। নিজের খেলার স্মৃতি নিয়ে গোষ্ঠ পালের সরল স্বীকারোক্তি “ট্রফি পাওয়ার কথা আমরা যত না চিন্তা করছি, সাহেব গো হারামু কি ক‌ইরা, হেই চিন্তাই তখন বেশি করচি। ট্রফি পাইনাই ব‌ইল্যা আমাগো দুঃখু নাই।” তখনকার দিনে প্রধান প্রতিপক্ষ সমন্ধে ওনার বক্তব্য “ক্যালকাটা ক্লাব ছিল এখানকার সাহেব গো ক্লাব। আমরাও এই খেলাটারে ধরতাম ব্রিটিশ ভারসাস ইন্ডিয়ানগো খেলা। তারাও মনে করত। আমাগো কোন‌ওবার হারাইলে ইংলণ্ডে তারা ক‌ইত ইন্ডিয়ারে হারাইছে।”

সেই সময়ে গোষ্ঠ পালের দল নিয়ে গান‌ও বাঁধা হয়-

“ব্যাক ফরোয়ার্ড সমান খেলি

যমের দোসর দুধারে 

আমাদের আর কে পারে।।

দলের ক্যাপ্টেন গোষ্ঠ-নাথ

খেলায় করি বাজিমাত 

পাস করি বল শুরু করি

সেন্টার থেকে কর্নারে 

আমাদের আর কে পারে 

হিপ হিপ হুররে 

ফিল্ডে নামলে শিল্ডটি নেব

কেয়ার কি করি কারে

আমাদের আর কে পারে।।”

( চারণ-কবি মুকুন্দ দাসের গানের সুরে ছন্দে মেলাতে, গোষ্ঠ কে গোষ্ঠ-নাথ বলা হয়েছে। যমের দোসর দুধারে বলতে পান্না পরামানিক ও গোষ্ঠ পাল-কেই বোঝানো হতো)

একবার এক ঘটনা ঘটে, পূর্ব পাকিস্তানে।

গোয়ালন্দ-গামী স্টিমারে এক বৃদ্ধা বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, পরের ঘাট-টাই গোয়ালন্দ কিনা? অনেকেই বিরক্ত হচ্ছিল বৃদ্ধার প্রশ্নে, কেউ উত্তর দিয়ে আশ্বস্ত করে, কেউ জানতে তিনি কোথায় যাচ্ছেন, তিনি উত্তর দেন‌- ‘ক‌ইলকাতায়’। সদ্য স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ডাকাতি-রাহাজানি থেকে বাঁচতে গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ এসে নতুন ভাবে বাঁচার চেষ্টায় এপারে আসতেন প্রচুর মানুষ। 

বর্ডারে বর্ডারে কাস্টমস এর অফিসারদের রোষানলে পড়তেন সাধারণ মানুষ। এই বৃদ্ধাও এক‌ই ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছিলেন, পরনের দিন, বাসন, কৌটোয় আঁচার বা আমসত্ত্ব, ভাগ করে অর্ধেক নিয়ে নেওয়া থেকে বাদ যাচ্ছিল না কিছুই। এমন সময়ে, ওই জিনিসপত্রের মধ্যে একটা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি দেখতে পায় কাস্টমস এর সেই অফিসার, জিজ্ঞেস করে “ এই ছবিটা কার, নানীমা?”

বৃদ্ধা বলেন, “আমার পোলার।”

অফিসার আরো জিজ্ঞেস করেন, “সত্যি ক‌ইত্যাছেন তো? পোলা করে কী এখন? 

বৃদ্ধা খানিক বিরক্তির সুরেই বলেন, “ সারা জীবন‌ই বল খেইল্যা গেল। করব আর কী, গদিতে বসে।” 

কথাটা শোনামাত্রই অফিসারটি যা যা জিনিস নিয়েছিল, সব গুছিয়ে ফেরত দিয়ে দেয় বৃদ্ধাকে ছেড়ে দেন, লজ্জা মিশ্রিত মুখে ক্ষমা চেয়ে নেন, “আপনার পোলারে আমার আদাব জানাইবেন। আমি ওনার খেলা দেখেছি অনেকবার। আপনার বাক্স ঘাঁটাঘাঁটি করতে হ‌ইছিল ব‌ইল্যা কিছু মনে ক‌ইরেন না।” 

আসলে ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা ছিল গোষ্ঠ পালের, অফিসারটি এতক্ষণ তাঁর মাকেই না বুঝেই আটক করে রাখেন।

৩. উত্তরনের পথে। ১৯১৪-১৬



১৯১৪ সালে প্রথমবারের জন্যে, কলকাতা লীগের দ্বিতীয় ডিভিশন-এ দুটো স্বদেশীয় ক্লাব অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। ১৯১১ সালের আই.এফ.এ শীল্ড জেতা ‘মোহনবাগান’ ও সদ্য ট্রেড্স কাপ (১৯১৩) জেতা স্যর দূখীরাম মজুমদারের ‘আরিয়ান’ ক্লাব, এই দুই দল হওয়ার সুযোগ পায়। শুধু তাই নয়, চিরাচরিত মোহনবাগানি মেজাজে প্রথম বছরেই প্রথম ডিভিশনের প্রমোশন আদায় করে নেয়। 

তবে সেই প্রমোশনের গল্প‌ও নেহাৎ কম চমকপ্রদ নয়। প্রথম সিজনে মোহনবাগান ১৬ ম্যাচে ২২ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় স্থানে শেষ করে, ‘৯১ হাইল্যান্ডার্স বি দল’ ও ‘মেজ়ারার্স ক্লাব’ এর পিছনে।
পয়েন্ট তালিকা অনুযায়ী, ৯১ হাইল্যান্ডার্স বি দলের প্রথম ডিভিশনে উত্তরন হ‌ওয়ার কথা, কিন্তু, আই. এফ.এর নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দল প্রথম ডিভিশনে খেললে, সেই দলের বি-টিম বা রিজ়ার্ভ দল সেই লিগে খেলতে পারবে না। তাতেও দ্বিতীয় দল হিসেবে মেজ়ারার্স ক্লাব এর প্রথম ডিভিশনে যাওয়ার কথা। 

মনে রাখতে হবে, মেজ়ারার্স দলটা কিন্তু কলকাতা বন্দরের পর্তুগিজ শুল্ক বিভাগের অফিসারদের তৈরি(খেলোয়াড়রা যদিও স্বদেশীয়‌ই ছিল), আই.এফ.এর ইংরেজ বাবুদের ব্যপারটা পছন্দ হল না। তারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় দল, মেজ়ারার্স ও মোহনবাগানের মধ্যে একটা প্লে-অফ খেলার ব্যবস্থা করে। ম্যাচ ১-১ ড্র হলে, রি-ম্যাচ হয়, মেজ়ারার্স ২-১ গোলে সেই ম্যাচ জিতে প্রথম ডিভিশনে চলে আসে।

অদৃষ্ট হয়তো মনে মনে হাসছিলেন, মোহনবাগানের প্রথম ডিভিশনে খেলা যে তিনি নিজের হাতে লিখে রেখেছেন। ১৯১৫ কলকাতা লীগের মরশুম শুরুর আগে ‘৬২ কম্পানি ও জি.এ’ দল ( মতান্তরে অন্য দল, কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ এক‌) আর্জি জানায়, তারা পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবে তারা প্রথম ডিভিশনে দল নামাতে পারবে না, তাদের সেই আর্জির কথা মাথায় রেখে, তাদের দ্বিতীয় ডিভিশন-এ খেলার সুযোগ করে দেওয়া হয়, ও দ্বিতীয় ডিভিশন-এ তৃতীয় স্থানে থাকা মোহনবাগান সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে, প্রথম ডিভিশনে খেলার সুযোগ পায়। 

প্রথম ডিভিশনে প্রথম বারের জন্য পদার্পণ করে নিজেদের জাত চেনাতে দ্বিধা বোধ করেনি, চতুর্থ স্থানে মরশুম শেষ করে। মোহনবাগান প্রথম ডিভিশনের প্রথম ম্যাচ খেলে ঐতিহ্যশালী ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব এর বিরুদ্ধে,  গোলশূন্য ভাবে শেষ হয় সেই ম্যাচ। ঐতিহাসিক সেই ম্যাচে প্রথম একাদশে খেলেন হীরালাল মুখোপাধ্যায় (গোলরক্ষক), গোষ্ঠ পাল, ভুতি সুকুল, হাবুল সরকার, ঘোষ, সান্যাল, রায়, দফাদার, চ্যাটার্জী, ভট্টাচার্য, ও এম. ভাদুড়ী।

১৯১৫ সালে আরো একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে। প্রেসিডেন্সি কলেজের সাথে, ফোর্ট উইলিয়ামের উত্তর-পূর্বে যে মাঠে মোহনবাগান খেলতো, সেই মাঠ ছেড়ে ময়দানে মাঠ পায় মোহনবাগান। ‘ন্যাশানাল’ দলের সঙ্গে এই মাঠ যৌথ ভাবে ব্যবহার করেছে ১৯৬৩ সাল অবধি। তারপর মোহনবাগান তাঁবু আজকের জায়গা, ইডেন গার্ডেনের উল্টোদিকে চলে আসে। ক্যালকাটা এফ.সির সাথেই যৌথভাবে ব্যবহার করা এই মাঠ, আজ‌ও মোহনবাগানের ‘ঘরের মাঠ’।

১৯১৬ মোহনবাগান মরশুম শুরু করে পঞ্চম কোচবিহার কাপটা জিতে নিয়ে। বস্তুত ১৯১১ এর শীল্ড জেতার পর এটাই তাদের প্রথম ট্রফি পাঁচ বছরে। কলকাতা লীগেও বেশ ভালো ফল করে, দ্বিতীয় স্থানে শেষ করে মোহনবাগান। সেবছর লীগ জেতে ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব (১৮৯৯,১৯০৭এর পর তৃতীয়বার এটা), যারা কলকাতার মাটিতে প্রতিষ্ঠিত প্রথম অসামরিক (ব্রিটিশ) দল।

এবার এই কলকাতা লীগে স্বদেশীয় ক্লাবের অংশগ্রহণ নিয়ে একটু বলি। ১৯১৪ সালে কলকাতা লীগের দ্বিতীয় ডিভিশন-এ মোহনবাগান ও আরিয়ান দল খেলার সুযোগ পায়। প্রথম ডিভিশনে মোহনবাগান পরের বছরই (১৯১৫) উঠে আসে। আরিয়ান দল প্রথম ডিভিশনে উত্তীর্ণ হয় ১৯১৬ সালে। ১৯১৭-১৯ তিনবার কুমোরটুলি, ‘২০ এ ‘টাউন ক্লাব’ দল দ্বিতীয় ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হলেও, প্রথম ডিভিশনে খেলার সুযোগ পায়নি ( দুটোর বেশি স্বদেশীয় ক্লাব সর্বোচ্চ লীগে খেলার নিষেধ ছিল আই.এফ.এর পক্ষ থেকে)। 

১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইস্টবেঙ্গল ক্লাব, কলকাতা লীগের দ্বিতীয় ডিভিশন-এ খেলার সুযোগ পায় ১৯২১ সালেই, পূর্ববঙ্গীয় ক্লাব ‘তাজহাট’ দল তুলে নেওয়ায়।  ৩ বছর পর, ১৯২৪ এ, ক্যামারুন্স বি দলের পিছনে দ্বিতীয় স্থানে শেষ করে , কিন্তু আই.এফ.এর এই বিকট নিয়মের দরুন প্রথম ডিভিশনে খেলার আটকে গিয়েছিল। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তাদের এই বিষয়ের বিরুদ্ধে সরব হয়ে, এই নিয়ম বন্ধ করে, এবং ইস্টবেঙ্গল তৃতীয় স্বদেশীয় ক্লাব হিসেবে কলকাতা লীগের প্রথম ডিভিশনে পা দেয়।


৪. উমাপতি কুমার, বিশ্বযুদ্ধ ও মোহনবাগান। ১৯১৬-২১



১৯১৬ সালে বিহারের পুর্ণিয়া জেলা থেকে ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন নিয়ে পাশ করে কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হতে আসেন ১৮ বয়সী তরুণ উমাপতি কুমার। সেখানে ‘অগিল্ভি’ হস্টেলে ঘর পেতে সাহায্য করেন স্কটিশ চার্চের আরেক ছাত্র, ১৯১১এর শীল্ড-জয়ী অভিলাষ ঘোষ। বস্তুত ১৯১১এ মোহনবাগানের শীল্ড জয় দেখেই ফুটবল খেলায় আগ্রহ জন্মায় ষষ্ঠ শ্রেণীর উমাপতির। 

স্কটিশ চার্চের সাথে জোড়াবাগান ক্লাবের এর এক ম্যাচে বাগান কর্মকর্তাদের চোখে পরেন। শোভাবাজার ক্লাবের বিরুদ্ধে আহসানুল্লাহ কাপে মোহনবাগানের হয়ে আত্মপ্রকাশ করেন উমাপতি। উমাপতি ওরফে ময়দানের ‘কুমারবাবু’র খেলার বিশেষত্ব ছিল ‘থ্রু’ পাস বা ‘ফরোয়ার্ড’ পাস। পায়ে বল জমাতে বা ‘ট্র্যাপ’ করে ‘থ্রু’ পাস বাড়াতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত, যেমন বল ধরায়, তেমন বল ছাড়ায়। ধাক্কাধাক্কি পছন্দ করতেন না, নিজে গোল করার চেয়ে নিজের সঙ্গীসাথীদের দিয়ে গোল করাতে বেশি উৎসাহী ছিলেন। 

টানা ২০ বছর, ১৯৩৬ অবধি ক্লাবের খেলে যান তিনি। তারপরেও ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৯ অবধি ক্লাবের সহকারী সভাপতি, ও ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ অবধি মোহনবাগানের সভাপতির পদ সামলেছেন। নাম-যশ থাকা সত্ত্বেও জীবন কাটিয়েছেন বাঙালি-সুলভ আটপৌরে ভাবেই, গাড়ির বদলে বাসে-ট্রামেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন, এমনকি ২৪ নং বালিগঞ্জ-এসপ্লানেড ট্রাম-রুটে ৩:১০এর ট্রাম-গাড়ির নিয়মিত প্যাসেঞ্জার হিসেবে বেশ পরিচিত‌ই ছিলেন উমাপতি।

১৯১৬-১৮, এই সময়ে মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন বিজয়দাস ভাদুড়ী। তারপরে, তিনি দল ছাড়লে, ১৯১১এর শীল্ডজয়ী দলের শেষ সদস্য হিসেবে মোহনবাগান দল ছাড়েন তিনি। শীল্ডজয়ের পরবর্তী দশকে উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় হিসেবে উঠে আসেন মতি সেনগুপ্ত(‘১৯- ‘২৯), মণি দাস(‘১৭- ‘২৪), রূপচাঁদ দফাদার(‘১২- ‘১৯), এস ঘোষ ও প্রকাশ ঘোষ(‘১৭- ‘২০)।  ১৯১৯-২০ সালে প্রকাশ ঘোষ অধিনায়কের দায়িত্ব সামলান। এর পরের ছ’বছর মোহনবাগানের অধিনায়কত্ব করেন গোষ্ঠ পাল।

১৯২০ সালে কলকাতা লীগে দ্বিতীয় স্থানে মরশুম শেষ করে, ১৯১৮এর পর ১৯২০ সালেও কলকাতা লীগ জিতে পঞ্চমবারের জন্য খেতাব জিতে নেয় ক্যালকাটা এফ.সি.।

১৯২০ সালে আই.এফ.এ শীল্ড সেমি-ফাইনালেও পৌঁছয় মোহনবাগান। যদিও কুমোরটুলির কাছে ১-২ গোলে হেরে, ট্রফি অধরাই রয়ে যায়। ফাইনালে ২-০ গোলে কুমোরটুলি-কে হারিয়ে আই.এফ.এ শীল্ড জিতে যায় সামরিক দল ‘ব্ল্যাক ওয়াচ’।

১৯২১ সালে কলকাতা লীগে আরেকবার দ্বিতীয় স্থানে শেষ করে মোহনবাগান, ২ পয়েন্ট বেশি পেয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ডালহৌসি এ.সি. (১৯১০ এর পর, এটা তাদের দ্বিতীয় কলকাতা লীগ খেতাব)। প্রসঙ্গত, সেবছর মাঠে জনরোষের মুখে পড়ে ক্যালকাটা-মোহনবাগান ম্যাচ, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেই ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুবেদার মেজর শৈলেন বসু যুদ্ধে অংশ নিতে যান। তাঁর অনুপস্থিতিতে , ওঁনার ভাই দ্বিজেন বসু ও দেবেন্দ্রনাথ গুঁই সচিবের দায়িত্ব সামলান।

১৯২১ সালে হুগলির ২১ বয়সী ছোকরা, বলাইদাস চাটুজ্জে মোহনবাগানে যোগ দেন। সেন্টার হাফ হিসেবে মোহনবাগানের দুর্গ পাহারা দেন ছ’বছর। পরে ক্লাবে ফুটবল সচিবের দায়িত্ব‌ও সামলান, 

১৯৪৪ সালে তার দায়িত্বেই প্রথমবারের জন্যে মোহনবাগানের জুনিয়র দল তৈরি করা হয়। ১৯৪৮এ স্বাধীন ভারতের প্রথম অলিম্পিকে, ফুটবল দলের ট্রেনার হিসেবেও নিযুক্ত হন বলাইদাস। শুধু তাই নয়, সন্তোষ ট্রফিতে তাঁর কৃতিত্বের নজির অসাধারণ। তাঁর অধীনে ১৯৪৯ থেকে ‘৫৯ অবধি ৬বার সন্তোষ ট্রফি জেতে বেঙ্গল দল। শৈলেন মান্না, সাহু মেয়ালাল, প্রদীপ ব্যানার্জি দের তৈরি করতে অন্যতম ভূমিকা নেন বলাইদাস।


৫. লোগো লোপাট ও শীল্ড ইতিহাস। ১৯১৮



কলকাতা যেমন শুধুমাত্র বাঙালির না, বিভিন্ন জনজাতির লোক এসে মিশেছে এখানে, তার সাথে নিজেদের গোষ্ঠীর একটা ক্লাব তৈরি করে কলকাতা লীগে এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতায় দল নামিয়েছে। ব্রিটিশ সামরিক দলের ভীড়ে ব্রিটিশ উচ্চপদস্থ পদাধিকারীদের তৈরী ক্যালকাটা এফ.সি.-ই কলকাতার প্রথম অসামরিক দল, তার দেখাদেখি ব্রিটিশ বণিক শ্রেণী তাদের নিজেদের একটা দল তৈরী করে - ডালহৌসি এ.সি. (ট্রেড্স কাপ‌ও এরাই শুরু করেন)। 

পর্তুগিজ শুল্ক বিভাগের অফিসারদের তৈরি ‘মেজ়ারার্স ক্লাব’এর কথা তো আগেই বললাম। তেমনি আর্মেনিয়ান-দের তৈরী ‘আর্মেনিয়ান ক্লাব’ বা রাজস্থানের মারোয়ার অঞ্চল থেকে আসা বণিক-সমপ্রদায়ের তৈরী ‘মারোয়ারী ক্লাব’ , মারোয়ার বা সুদূর আর্মেনিয়ায় অবস্থিত নয়, বরং খোদ কলকাতায়। ১৯৩২ সালে এই ‘মারোয়ারী ক্লাব’ কলকাতা লীগের চতুর্থ ডিভিশনে খেলার সুযোগ পায়। 

৫ বছর পর তারা তৃতীয় ডিভিশনে উঠে আসে, আরো ৫ বছর পর, ১৯৪২এ , তারা দ্বিতীয় ডিভিশন-এ উত্তীর্ণ হন। ৬ বছর পর, দ্বিতীয় ডিভিশনের চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম ডিভিশনে উঠে আসে তারা, সেই সঙ্গে নিজেদের নাম পাল্টে রাখে ‘রাজস্থান ক্লাব’। এর সাথেই নতুন দিগন্ত ছুঁয়ে ফেলে তারা,১৯৫৫ সালে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে

তারা ‘ইন্ডিয়ান কালচার লিগ’(১৯৫৩) এর পর দ্বিতীয় দল হিসেবে আই.এফ.এ শীল্ড জেতে (ফাইনালে প্রতিপক্ষ ‘আরিয়ান’), সাময়িক ভাবে প্রশ্ন তোলে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের আধিপত্য নিয়ে ।

১৯৬২ সালে ময়দানে মাঠ পায়ে তারা। এই দলের‌ই ক্রিকেট শাখার প্রাক্তন সচিব জগমোহন ডালমিয়া, পশ্চিমবঙ্গের ক্রিকেট সংস্থা (সি.এ.বি) ও পরে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বি.সি.সি.আই) প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের নজির রাখেন।

তবে ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়ার সময়ে একটা কাণ্ড‌ই ঘটিয়ে ফেলে এই ‘রাজস্থান ক্লাব’, ক্লাবের লোগো খেয়াল করলে দেখা যাবে মোহনবাগান লোগোর রয়েল বেঙ্গল বাঘ থেকে বাঘের পেছনে তালগাছ ,সব‌ই বিরাজমান রাজস্থান ক্লাব এর লোগোতে।

প্রসঙ্গত, লোগোতে মোহনবাগানের কোনো কপিরাইট করানো ছিল না। মোহনবাগান বারবার রাজস্থানকে লোগো বদলের আবেদন জানালেও রাজস্থান ক্লাব কোনো কর্ণপাত করেনি। শেষমেষ মোহনবাগান ঠিক করে, তারাই তাদের লোগো বদল করে নেবে, যাতে মানুষের মধ্যে দুই দল নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি না হয়।  মোহনবাগান কর্তারা ঠিক করেন গ‌ঙ্গাপারের ক্লাবের লোগো ‘গঙ্গা’ , ও এই নদী-মাতৃক দেশে, অন্যতম প্রধান যান- ‘নৌকো’ , এই দুইই থাকবে নতুন লোগো তে। গঙ্গার ওপরে পালতোলা নৌকোর এই লোগো, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে, মাঝেমাঝে সামান্য বদল করে, আজ‌ও সমানে চলে আসছে, মোহনবাগানের পরিচয়-স্বরূপ হয়ে।

এবার আমরা একটু অন্য বিষয়ে জেনে নিই- আই.এফ.এ শীল্ড। 

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ময়দানে ৩ প্রধান বাদে আই.এফ.এ শীল্ড জেতা ভারতীয় টিমগুলো হল- 

ইন্ডিয়ান কালচার লিগ (১৯৫৩)

রাজস্থান ক্লাব (১৯৫৫)

বি এন আর- বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে (১৯৬৩)

জে সি টি (১৯৯৬)

মাহিন্দ্রা ইউনাইটেড (২০০৬, ‘০৮)

চার্চিল ব্রাদার্স (২০১১)

ইউনাইটেড এস.সি. (২০১৩, ‘১৫)

টাটা ফুটবল একাডেমী (২০১৬)

এফ.সি. পুণে সিটি (২০১৭)

রিয়াল কাশ্মীর (২০২০, ‘২১)

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শীল্ড জেতা বিদেশি দলগুলো হল:

 🇦🇲/USSR আরারাত ইয়েরেভান (১৯৭৮)( মোহনবাগানের সাথে যুগ্ম বিজয়ী)

 🇺🇾 ক্লাব অ্যাথলেটিকো পেনারোল (১৯৮৫)( বিজিত- 🇺🇦/USSR শাখতার দোনেৎস্ক )

 🇺🇿 পাখতাকর তাশকেন্ত এফ.কে (১৯৯৩)( বিজিত- 🇰🇿 ইর্তিশ পাভলোদার)

 🇹🇼 ফিন্যান্স অ্যান্ড রেভিনিউ এফ.সি (২০০৪)

 🇩🇪 এফ.সি. বায়ার্ন মিউনিখ ।। (২০০৫)

২০১৫-১৮  এটি একটি অনূর্ধ্ব উনিশ প্রতিযোগিতা হিসেবে অনুষ্ঠিত করা হয়, তবে ‌তার আগের বছর (২০১৪) মোহনবাগান ফাইনাল না খেললেও, সেই ফাইনাল মোহন-জনতার অনেকদিন মনে থাকবে। কলকাতার মোহামেডান দল,  বাংলাদেশের দল ‘শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব’ পেনাল্টিতে হারায়, তবে তার চেয়ে বড় কথা এক দল থেকে আমরা একজন কোচকে পাই, যিনি আমাদের প্রথম আই-লিগ এনে দেবেন (সঞ্জয় সেন, ২০১৫), আরেকদল থেকে আমরা পাবো আমাদের নয়নের মণি (সনি নর্দে 🇭🇹)।

৬. হাইকোর্ট নয়, বাঙালের সাথে প্রথম দেখা ময়দানে: প্রসঙ্গ ইস্টবেঙ্গল ও প্রথম ‘বড়ম্যাচ’। ১৯২০-২৫



১৯২০ সালে ২৮এ জুলাই কোচবিহার কাপের ম্যাচ জোড়াবাগান ও মোহনবাগানের মধ্যে। গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচে পূর্ববঙ্গীয় বা ‘বাঙাল’ হ‌ওয়ার দরুন জোড়াবাগান দল শৈলেশ বসু নামের এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে বসিয়ে দেওয়া হয়। ক্লাব সভাপতি, সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী, নিজে কথা বললেও, কিছু পরিবর্তন না হ‌ওয়ায়, সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী, শৈলেশ বসু, জোড়াবাগান ক্লাব ছেড়ে দিয়ে, ও অন্যান্য পূর্ববঙ্গীয়দের নিয়ে ১লা আগস্ট তৈরী করে নতুন এক ক্লাব , যেখানে ‘বাঙাল’ জাত্যাভিমান প্রাধান্য পাবে- ‘ইস্টবেঙ্গল ক্লাব’। 

স্বাধীনতা ও দেশভাগ পরবর্তী পর পর দশক জুড়ে উদ্বাস্তুরা ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে বারবার বনগাঁ, বরানগর, বিজয়গড়, শিয়ালদহ স্টেশনে, সহায়সম্বলহীন সর্বস্ব হারানো এই মানুষগুলোর কাছে সব বাধা-বিপদ কাটিয়ে, মাটি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার প্রতীক - ইস্টবেঙ্গল। প্রসঙ্গত, পূর্ববঙ্গের অন্যান্য ক্লাব‌ , উয়ারী, ভিক্টোরিয়া ইত্যাদি থাকলেও ইস্টবেঙ্গলের মতো উন্মাদনা এবং সাফল্য অন্য ক্লাব-রা পায়নি।

১৯২০ এর কোচবিহার কাপের ম্যাচ দিয়ে যদি ইস্টবেঙ্গলের যাত্রা শুরু হয়, ১৯২১ এর কোচবিহার কাপে হয় প্রথম ‘বড়ম্যাচ’ । শুরুতে যা ছিল ফুটবল মাঠে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, তার সাথে কালে কালে এসে মিশেছে ঘটি-বাঙাল বৈরীতা, চিংড়ি-ইলিশ রসিকতা, ‘মাচা’-লোটা’ বিদ্রুপ, ‘অ্যারিস্টোক্রেসি’-কলোনী দ্বন্দ্ব , যথার্থ‌ই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ রূপ নিয়েছে ‘বড়ম্যাচ’ বা ‘ডার্বি’ হিসেবে।

১৯২১ এর ৮ই আগস্ট কোচবিহার কাপের সেমিফাইনালে প্রথম মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ হয়, ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হয়, দুদিন পর, ১০ তারিখ ‘রিম্যাচ’ হলে মোহনবাগান সেই ম্যাচ ৩-০ জেতে (ফাইনালে আরিয়ানকে হারিয়ে সেবার কোচবিহার কাপ‌ জিতে নেয় মোহনবাগান)। তবে এর ১৬ দিনের মাথায় আবারো মুখোমুখি হয় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, এবার খগেন্দ্র শীল্ড ফাইনালে ‘নব্য’ ইস্টবেঙ্গল ২-১ গোলে ‘ঐতিহ্যবাহী’মোহনবাগানকে পরাজিত করে ট্রফি তুলে নেয়।

১৯২১এর পর ‘২২এর কোচবিহার কাপের সেমিফাইনালেও দেখা যায় ইস্ট-মোহন দ্বৈরথ , সেই ম্যাচ এবারে মোহনবাগান জিতে নেয় (সেবার‌ও ফাইনালে জেতে মোহনবাগান)।

১৯২৫এ ইস্টবেঙ্গল কলকাতা লীগের প্রথম ডিভিশনে উঠে আসলে, কলকাতা লীগেও ‘বড়ম্যাচ’ শুরু হয়। ১৯২৫ এর কলকাতা লীগে ‘বড়ম্যাচ’-এর আগে অবধি মোহনবাগান অপরাজিত ছিল, কিন্তু কলকাতা লীগের প্রথম ‘বড়ম্যাচ’-এ নেপাল চক্রবর্তীর ইস্টবেঙ্গল হারিয়ে দেয় মোহনবাগানকে। 

ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’ সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের রিপোর্ট-বিবরণীতে লিখছে, “N.(নেপাল) Chakravarty scored the winning goal, and it was quite the effort. A swift low drive struck the upright and Chakravarty got his foot to the ball as it rebounded. The shot beat the goalkeeper who was on the ground.”

শতাব্দী-প্রাচীন এই ‘বড়ম্যাচ’ ঘিরে আজ‌ও বাঙালির এক‌ই রকম উন্মাদনা।


৭. স্বপ্নের শহর বম্বে, রোভার্স কাপ ও আরেকবার শীল্ড ফাইনাল। ১৯২৩-২৪



মোহনবাগান বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বারংবার ফাইনালে, সেমিফাইনালে উঠলেও ট্রফি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। কলকাতা লীগেও বেশ কয়েকবার দ্বিতীয় স্থানে শেষ করলেও(যা বেশ কৃতিত্বের), চ্যাম্পিয়ন হ‌ওয়া যায়নি। তবুও মোহনবাগান খ্যাতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। ১৯২৩ সালে প্রথম অসমারিক ও স্বদেশীয় দল হিসেবে রোভার্স কাপে খেলার নিমন্ত্রণ পায় মোহনবাগান।

মোহনবাগান এতোদিন ম্যাচগুলো খেলেছে  কলকাতা, বঙ্গ বা মূলত পূর্ব ভারতে, আই.এফ.এর অধীনে। কিন্তু রোভার্স কাপ খেলা হয় বম্বে তে, সে সময়ে এই প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিল ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউ.আই.এফ.এ, স্থাপিত:১৯১১)। প্রসঙ্গত, ডুরান্ড কাপ ও ট্রেড্স কাপ এর পরে ভারতের তৃতীয় প্রাচীনতম প্রতিযোগিতা হল এই রোভার্স কাপ।

১৯২৩ সালে মোহনবাগান শুধু এই নিমন্ত্রণ রক্ষাই করলো না, একের পর এক দল হারিয়ে একেবারে ফাইনালে চলে গেল। ফাইনালে প্রথম গোল করলেও প্রতিপক্ষ ( এবং আগের বারের বিজয়ী দল) ‘ডারহাম লাইট ইনফ্যান্ট্রি দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন’ ৪ গোল দিয়ে দেয়। ৪-১ গোলে ম্যাচ হেরে ট্রফি অধরাই থেকে যায়। 

১৯৪৮ সালে আরেকবার রোভার্স ফাইনালে উঠলেও, মোহনবাগান প্রথম রোভার্স কাপ জেতে ১৯৫৫ সালে। ১৪টা রোভার্স কাপ জিতে আজ‌ও সর্বোচ্চ রোভার্স জেতার মুকুট আজ‌ও মোহনবাগানের মাথাতেই।

১৯২৩ সালে আরেকটা ফাইনালে ওঠে এই দল। ১৯১১এর পর দ্বিতীয়বার আই.এফ.এ শীল্ড ফাইনালে ওঠে মোহনবাগান। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ‘ক্যালকাটা এফ.সি.’।‌১৯২০, ‘২২, ও ‘২৩ এ কলকাতা লীগে জিতে নেওয়া সেই দলে ছিল মেয়ার, ব্রুকস, বেনেট এর মতো তৎকালীন নামজাদা খেলোয়াড়রা। আই.এফ.এ শীল্ডেও তাদের স্বপ্নের দৌড় চলছিল, ‘২১, ‘২২, ‘২৩ পরপর ৩ বছর তারা শীল্ড ফাইনালে ওঠে, ‘২১ এ রানার্স আপ হলেও, ‘২২এ জিতে, ‘২৩এর এই ফাইনালে তারা নামে ‘ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে, এবং সেই ম্যাচে মোহনবাগানকে ৩-০ হারিয়ে তারা নিজেদের শীল্ড ‘ডিফেন্ড’ও করে।

তবে মোহনবাগান এই ম্যাচ ‘ক্যালকাটা এফ.সি.’-এর কাছে হারলেও তাদের আসল প্রতিপক্ষ ছিল খেলার মাঠ। বৃষ্টির দরুন জলে ভরা কাদা-মাঠের অবস্থা এতোই খারাপ ছিল যে, এটা যদি বুট-পরিহিত কোনো ব্রিটিশ প্রতিপক্ষ হত, ইংরেজ রেফারিরা ম্যাচটা পিছিয়ে অন্যদিন ম্যাচটা আয়োজন করার কথা হ‌য়তো ভাবতেন, কিন্তু প্রতিপক্ষ ‘ভারতীয়’ ক্লাব মোহনবাগান হ‌ওয়ায় তারা মাঠের অবস্থার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়নি। দৈনিক 'দ্য স্টেটসম্যান' লিখছে, ‘Mohun Bagan’s game fight on sodden ground- Good play impossible’।

১৯২৪ এর ১৩ই সেপ্টেম্বর বাগানের প্রথম ক্লাব সভাপতি এবং অভিভাবক-স্বরূপ ভুপেন্দ্রনাথ বসু ৬৫ বছরে বয়সে প্রাণত্যাগ করেন। নিজের জীবনের ৩৫টি বছর সঁপে দিয়েছিলেন মোহনবাগানের চিন্তায়, মোহনবাগানের উন্নতি নিয়ে। 

বিশিষ্ট শিল্পপতি ও ‘মার্টিন অ্যান্ড কো.’-এর যৌথ প্রতিষ্ঠাতা (আরেকজন- স্যার টমাস অ্যাকুইন মার্টিন) ও মালিক, স্যার রাজেন মুখার্জি, এরপর ক্লাব সভাপতির দায়িত্ব তুলে নেন।


৮. শিমলা জমজমাট, ডুরান্ড আমন্ত্রণ। ১৯২৫



১৮৮৪ সালে স্যার হেনরি মর্টিমার ডুরান্ড ‘ডুরান্ড লাইন’ রেখা টেনে দেন, যা আজকের পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ‘৮৮ সালে, অসুস্থ হয়ে, জীবনে খেলাধুলোর গুরুত্ব বুঝে, শিমলার কাছে ‘দাগশাই’তে একটা ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজন করার ব্যবস্থা নেন, ওনার নামেই প্রতিযোগিতার নাম রাখা হয় ডুরান্ড কাপ। 

ভারত তথা এশিয়ার প্রাচীনতম এই প্রতিযোগিতায়, শুরুতে শুধুমাত্র ব্রিটিশ সামরিক দলগুলোই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতো (এমনকি বর্তমান সময়ে, ডুরান্ড কাপের অন্যতম আয়োজক ভারতীয় সেনাবাহিনী, এবং এই প্রতিযোগিতাতেই একমাত্র ভারতের বিভিন্ন সামরিক দলগুলোর খেলা দেখা যায়।)।

১৯২৫ সালে প্রথম অসমারিক ও স্বদেশীয় দল হিসেবে মোহনবাগান ডুরান্ড কাপে খেলার নিমন্ত্রণ পায়। রোভার্স কাপের মতোই এই খেলা হবে কলকাতা বা পূর্ব ভারতের থেকে বহুদূরে, শিমলা-দাগশাইতে। ‘দাগশাই’ নামটা এসেছে ‘দাগ-এ-শাহী’ বা ‘শাহী দাগ’ কথাটার থেকে। মুঘল আমলে অপরাধীদের সহজে চিহ্নিত করতে এই ‘শাহী দাগ’ লাগিয়ে এই জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হত। ব্রিটিশরা এই গ্রামটা একটা ক্যান্টনমেন্টে পরিণত করেন, তার সাথে তৈরী করে একটা জেলখানা ও যক্ষারোগীদের জন্যে একটা ‘স্যান্ক্টোরিয়াম’। শহর শিমলাও ছিল ব্রিটিশদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। 

প্রতিযোগিতায় নেমে মোহনবাগান প্রথমেই হারায় ‘রয়াল বার্কশায়ার রেজিমেন্ট’ দলকে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে যথাক্রমে, ‘ইয়োর্ক ল্যাংকাশায়ার রেজিমেন্ট’ ও ‘এসেক্স রেজিমেন্ট’ হারিয়ে মোহনবাগান পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে। সেমিফাইনালে শক্তিশালী ‘শের‌উড ফরেস্টার্স’ যদিও মোহনবাগানকে হারিয়ে দেয়, এবং ফাইনালে ‘ওর্চেস্টারশায়ার রেজিমেন্ট’কে ৩-১ হারিয়ে সেবছর ডুরান্ড কাপ জিতে নেয় এই ‘শের‌উড ফরেস্টার্স’।

মোহনবাগান প্রথম ডুরান্ড কাপ জেতে ১৯৫৩ সালে। ডুরান্ড কাপ-ই এমন একটা প্রতিযোগিতা, যেটা জিতলে একটা নয়, তিন তিনটে ট্রফি প্রায় বিজয়ী দল।

ট্রফিগুলি হল-

১. ডুরান্ড কাপ (ওরফে ‘মাস্টারপিস’)

২. শিমলা ট্রফি (ওরফে ‘আর্টিস্ট্রি’, ১৯০৪ সাল থেকে শিমলার সাধারণ মানুষ এই ট্রফিটা দান করে, এই প্রতিযোগিতার প্রতি নিজেদের উৎসাহ দেখাতে)

৩. প্রেসিডেন্ট’স কাপ (ওরফে ‘প্রাইড’, ‘ভাইসরয় কাপ’-এ এই ট্রফিটা দেওয়া হতো, পরে স্বাধীনতার পরে ডুরান্ড কাপ শুরু হলে, এই ট্রফিটাও ডুরান্ড কাপের সাথে দেওয়া হয়)

১৯২৫তে প্রথম ডুরান্ড অভিযান থেকে ‘৫৩ এ প্রথম ডুরান্ড জয় দিয়ে শুরু করে, বাগানের ঘরে আজ, এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ ডুরান্ড কাপ জয়ের (১৭টা*) নজির। 

পরের সংখ্যায়  আমরা দেখবো মোহনবাগানের পালতোলা নৌকা কীভাবে পৌঁছে যায় গুজরাটের বন্যায়, কীভাবেই কলকাতার ময়দানে ঘটে গিয়েছিল এক অভিনব অপহরণ ও এরকম আরো কিছু শিহরণ জাগানো গল্পের খোঁজে চোখ রাখুন MBFT-এর পোর্টালে।


> প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে: “পথচলার শুরু: কীভাবে এবং কেনোই বা জন্ম নিলো মোহনবাগান

> দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখানে: মোহনবাগানের প্রথম দু'দশক (১৮৮৯-১৯১০)

> তৃতীয় পর্ব পড়ুন এখানে: ১৯১১’র যুদ্ধজয়

> চতুর্থ পর্ব পড়ুন এখানে: মোহনবাগান, শীল্ড জয়ের পরবর্তী দশক (১৯১২-২৪)

> Read EP1 in English Here: The Complete Origin Story of Mohun Bagan

> Read EP2 in English Here : The First Two Decades Of Mohun Bagan (1889-1910)

Read EP3 in English Here : The Victory of 1911

> Read EP4 in English Here : Nine Stories from MohunBagan's Postt 1911 shield era till 1925

আমাদের MBFT কে ফেসবুকইনস্টাগ্রামট্যুইটারইউটিউবওয়াটসঅ্যাপ  গুগল নিউজে ফলো করুন, মোহনবাগান সংক্রান্ত সকল তথ্য সবার আগে পাওয়ার জন্য 

1 Comments

  1. অসাধারণ, পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম 💚❤️

    ReplyDelete
Previous Post Next Post